Header Ads

হেলায় বেচেছে তাজমহল,সংসদ; জাল করেছে রাষ্ট্রপতির সই! জানেন কে সেই প্রতারক? #SpecialArticle

অরুনাভ সেনঃ এই শিল্পী-প্রতারকের চালে ঘায়েল হয়েছেন বিড়লা-অম্বানিদের মতো শিল্পপতিরাও। লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন বা সংসদ-ভবন হেলায় বেচেছেন বার বার। সই জাল করেছেন খোদ রাষ্ট্রপতিরও। অমিতাভ-অভিনীত ‘মিস্টার নটবরলাল’-এর প্রেরণাও তিনিই। ১৯৯৬ সালে ৮৪ বছর বয়সে হুইলচেয়ার-বন্দি দশায় শেষ বার পুলিশকে ঘোল খাওয়ান। এই গুণধর মানুষের গল্প অনেকে জানেন,অনেকে জানেন না৷ সামান্য সময় নিয়ে পড়ুন নটবরলালের গল্প শুনুন,প্রতারক হলেও শুনতে মন্দ লাগবে না নটবরলালের প্রতারণার কথা!বোধহয় হলফ করে বলা যায়!গল্পের শুরু করতে হয়,তবে শুরুই হোক সেই প্রতারকের গল্প।
আমেরিকান এক দম্পতি মধুচন্দ্রিমায় এসেছেন ভারতে, দাঁড়িয়ে আছেন সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের অপূর্ব নিদর্শন তাজমহলের সামনে। সেখানেই সরকারী কর্মকর্তা সেজে তাদের কাছে পুরো তাজমহলটি বিক্রির প্রস্তাব দিলেন মিথিলেশ৷তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী সরকারী কোষাগার প্রায় খালি, শ্বেতহস্তীর রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো টাকা সরকারের কাছে নেই- অল্পদিনের মধ্যেই বিক্রির জন্যে নিলামে উঠবে হয়তো সব কিছু, এই কাজে সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খোদ মিথিলেশই নাকি স্বয়ং! মিথিলেশের ঝরঝরে কথাবার্তায় আর অনর্গল ইংরেজীতে মুগ্ধ হলেন আমেরিকান দম্পতি৷ বিশেষ করে স্বামী ভদ্রলোক।কিছু টাকার বিনিময়ে তাঁরা দুনিয়ার সপ্তম আশ্চর্যের একটি তাজমহলের একেবারে মালিক হয়ে উঠবেন৷অতএব কিছু কিছু টাকা খসে খসুক,কুচ পরোয়া নেই! আমেরিকান দম্পতির ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, তাই তাগাদা দেওয়া হলো মিথিলেশকে। টাকার অঙ্কটা জানা যায়নি, সত্তরের দশকে লাখ দশেক, এখনকার হিসেবে দশ কোটির বেশিই হবে৷দম্পত্তি টাকার ব্যবস্থা করলেন,আর হ্যাঁ তাজমহলের সামনেই হলো লেনদেন৷টাকা নিয়ে সই-সাবুদ সম্পন্ন করা হলো৷
যুগলের বক্তব্য অনুযায়ী মিথিলেশের ধার্য করা তাজমহলের দামের অর্ধেক মেটানো হয়েছিল তাঁকে৷ সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে দুইদিন পর তাজমহলের সামনেই আসবে বলে বিদায় নিলেন তিনি, প্রত্নতাত্ত্বিক মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও হাজির থাকবেন সেদিন- এমনটাই জানিয়েছিলেন মিথিলেশ। দু’দিন পর স্বামী-স্ত্রী টের পেলেন কতো বড়ো জালিয়াতের পাল্লায় পড়েছেন৷থানা-পুলিশ সবই হল,কিন্তু মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব, ওরফে নটবরলাল ততক্ষণে হাওয়া৷এরপরেও আরও দুবার বিক্রি করেছেন তাজমহল৷ একবার তো মন্ত্রী-সাংসদ সমেত নাকী বিক্রি করে দিয়েছিলেন খোদ সংসদ ভবনই৷শুধু ক্রেতাদের বোকামি বললে নটবরলালকে ছোট করে দেখানো হবে। তার কথার কারসাজি, বিভিন্ন কৌতুহল দমনে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর যে কারও উপর খুব সহজেই প্রভাব বিস্তার করতো। আর সেই কারণে শুধু কি তাজমহল? ৫৪৫ জন সাংসদসহ পুরো সংসদভবন, লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতিভবন এ সবকিছু বিক্রি করেছিলেন তিনি চড়া দামে বিভিন্ন খদ্দরের কাছে। শুধু সাধারণ মানুষই নন টাটা, বিরলা , অম্বানি মিত্তলও এই ঠগবাজের শিকার। এভাবেই দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ এই নটবরলালের শিকার হয়েছেন৷যে লোকটা প্রতারণাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পরিচয় জানতে নিশ্চয়ই সবাই উৎসুক হবেন৷কে এই নটবরলাল?
বিহারের সিওয়ান জেলার বানগ্রা গ্রামে ১৯১২ সালে নটবরলালের জন্ম। তার আসল নাম কিন্তু নটবরলাল নয়।আসল নাম মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব৷ নটবরলালের একটি বিশেষ গুণ ছিল। আর সেটি হলো অন্যের সই নিখুঁত জাল করা প্রতারণায় হাত পাকানোয় দারুন গল্প আছে৷গ্রামের এক বৃদ্ধ তাকে শহরে ব্যাংক থেকে চেকে সই দিয়ে টাকা উঠানোর জন্য পাঠাতেন। একদিন মিথিলেশের এর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত মিথিলেশ চেক বইয়ের কয়েকটা পাতা চুরি করে নিল। ব্যাংকে সই নকল করে ১,০০০ টাকার চেক লিখল এবং একটু ভয়ে ভয়ে ব্যাংকে জমা দিল। সেই চেক ব্যাংকে গ্রহণ করল এবং তাকে এক হাজার টাকা দিল।এরপর প্রতারণা জগতে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি নটবরলালকে৷কেরিয়ার এগিয়েছে একেবারে মসৃণভাবে,জেট গতিতে৷ দেখতে খুব একটা আলাদা করে বলার মতো কিছু নয়। আর পাঁচটা লোকের মতোই তিনিই দেখতে৷আলাদা কোনও বাহ্যিক সৌন্দর্য ছিল না,কিন্তু যেটা ছিল সেটি প্রতারণার জন্য যতেষ্টই ছিল৷ ঠগবাজি করে প্রচুর অর্থ সম্পত্তির মালিক হন এই মানুষটি৷তাবড় তাবড় গোয়েন্দা, অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে ঘোল খাওয়া নটবরলাল শুধু টাকার জন্য এই ঠগবাজি করত বলে মনে হয় না।বরং এটা যেন তার নেশা,হবি৷ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পুলিশকে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে অনায়াসে ঘোল খাওয়াতে পারতেন নটবরলাল৷সম্ভবত সেই নেশাই তাকে তার ওকালতি পেশা থেকে স্থায়ীভাবে এই ঠগবাজি পেশায় আনতে বাধ্য করে।
তবে ভাববেন না ঠগবাজি করে নটবরলালের জীবন বইছিল খুব মসৃণ৷এমনটা কিন্তু নয়৷বরং অনেক ঘাত প্রতিঘাতও পোহাতে হয়েছিল তাকে। অন্তত ১০০টি প্রতারণার কেস ও জোচ্চুরির মামলায় নটবরলালের পিছনে আঠার মতো লেগেছিল ৮টি রাজ্যের বিশাল পুলিশ বাহিনী। বিভিন্ন মামলায় তার সাজার সম্মিলিত মেয়াদ হয় ১১৩ বছর।কিন্তু জেলের নিরাপত্তাকে ও পুলিশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৯ বার ধরা পড়েও জেল ভেঙে পালিয়েছে এই প্রতারক, চলে গিয়েছে পুলিশের নাগালের বাইরে। ফের ধরা পড়েছে, ফের পালিয়েছে। জেল ভাঙা যেন তাঁর কাছে জলভাত! সর্বসাকুল্যে ১১৩ বছরের জেলের পরিবর্তে শুধুমাত্র ২০ বছরের মতো জেল জীবন কাটিয়েছে নটবর৷ ১৯৯৬ সালে ৮৪ বছর বয়সে জেলবন্দি থাকার সময় অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে থাকার অনুমতি জোগাড় করে নটবরলাল।কিন্তু আবারও পালাতে সক্ষম হয় নটবরলাল৷ অপরাধ নিয়ে গবেষনা করা মানুষদের কাছে নটবরলাল চূড়ান্ত কৌতূহলের কেন্দ্র। কোন জাদুতে সে লোক ঠকিয়ে তাজমহল, লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন ও সংসদ ভবন বিক্রি করে মোটা টাকা রোজগার করেছিল তা-ও এক অবাক কান্ড। নটবরলালের নাম নিয়ে হিন্দিতে দুটো সিনেমাও হয়েছে। একটিতে অমিতাভ বচ্চন এবং অন্যটিতে ইমরান হাশমি অভিনয় করেন। প্রতারণার ধরনের কারণে তাকে অনেকসময় ‘ফ্র্যাঙ্ক অ্যাবাগনেল’ এবং ‘ভিক্টর লুস্টিগ’-এর সাথে তুলনা করা হয়। প্রকৃত অর্থেই নটবরলাল বোধহয় ছিল তার সময়ের প্রতারকদের মধ্যে সেরাদের সেরা।

No comments

Theme images by lishenjun. Powered by Blogger.