Header Ads

সি এম জ্যোতি বসু।

নজরবন্দি : কেউ বলতেন জ্যোতি বসু। কেউ বলতেন জ্যোতি বাবু। কেউ বলতেন, মিস্টার বাসু। কেউ বলতেন সিএম। কিন্তু কাউকে কখনও ‘জ্যোতিদা’ বলতে শুনেছেন? ক্যাবিনেটের সদস্য থেকে দলীয় নেতা। সিনেমা তারকা থেকে সাংবাদিক। শিল্পী থেকে শিল্পপতি। আমলা থেকে সাহিত্যিক। কারও কাছেই তিনি ‘দাদা’ ছিলেন না। হয়ে ওঠার চেষ্টাও করেননি। হঠাৎ রাস্তায় নেমে ঝালমুড়ি খেতে হয়নি। ভিড়ের মধ্যে এর তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছবি তুলতে হয়নি। কারও বাচ্চাকে কোলে নিয়ে গাল টিপে দিতে হয়নি। কারও মোটর সাইকেলের পিছনে চেপে বসতে হয়নি। বলতে পারেন, জনতার সঙ্গে নিবিঢ়ভাবে মেশার চেষ্টা করেননি। কেউ বলতেই পারেন, উন্নাসিক। কেউ বলতে পারেন দাম্ভিক। কিন্তু তিনি এইরকমই। তিনি যেমন, তিনি তেমনই। ফটোগ্রাফারদের পোজ দেওয়ার জন্য বাড়তি কিছু করতে হয়নি। কাগজে ছবি ছাপাতে গিয়ে কাছাকাছি আসার ভনিতা করতে হয়নি। জ্যোতিবাবু কি কবিতা পড়তেন? কী জানি। নিজের মুখে কখনও কবিতা আওড়াতে অন্তত শোনা যায়নি। জ্যোতি বাবু কি গান শুনতেন? বোঝার উপায় নেই। জ্যোতি বাবু সিনেমা দেখতেন? তাও বলা মুশকিল। কারণ, কোন অভিনেতাকে কেমন লাগে বা কোন সিনেমা কেমন লেগেছে, এসব নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি। জ্যোতিবাবু কি ডাক্তারি বুঝতেন? শিল্প–সংস্কৃতি বুঝতেন? বলা মুশকিল।
 কারণ, প্রকাশ্যে এসব নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি। আসলে, তিনি এরকমই। যেটা বোঝেন না, জোর করে বুঝি প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি। কোন কাগজ কী লিখল না লিখল, তাতে তাঁর খুব একটা মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। অন্তত প্রকাশ্যে সেভাবে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। চূড়ান্ত সমালোচনা করলেও বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যায়নি। কজন সাংবাদিককে নামে চিনতেন, তাও সন্দেহ আছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে মুড়ি খাওয়া, রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়া বা রাজ্যসভায় পাঠানো, এসব থেকে অনেকটাই দূরে। তাঁর বৃত্তে পৌঁছতে না পারলে দূর থেকে ‘উন্নাসিক’ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি বুঝতেন, মানুষ কী চায়। বুঝতেন, মানুষের কোনটা প্রয়োজন। তাই ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে ভূমি সংস্কারের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি। শুধু সিদ্ধান্ত নিয়েই ক্ষান্ত হননি, কঠোরভাবে রূপায়ণ করেছেন। চোদ্দ লক্ষ একর জমি বিলি হয়েছে প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে। ভাবা যায়! প্রথম দিনেই বলেছিলেন, রাইটার্স থেকে সরকার চালানো হবে না। গ্রামের উন্নয়ন গ্রামের মানুষ ঠিক করবেন। ঠিক পরের বছরই সার্বিক পঞ্চায়েত। তিনটি স্তরে বেঁধে দিলেন গ্রামীণ উন্নয়নের রূপরেখা। গ্রামের চাষিও হয়ে গেলেন পঞ্চায়েত প্রধান। গ্রামের উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করলেন গ্রামের মানুষেরাই। কোথাও কৃতিত্ব নিতে যাননি। পঞ্চায়েত বা পুরসভার কাজে ফিতে কাটতে যাননি। পাড়ার রাস্তা থেকে পুকুর ঘাট বাঁধানোয় ‘অনুপ্রেরণা’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি। আবার যখন শিল্পের প্রয়োজন, তখনও সময়ের দাবি মেনে অগ্রাধিকার বেছে নিতে ভুল করেননি। রাজারহাটের মতো আস্ত উপনগরী নিঃশব্দে হয়ে গেল। কেউ টেরও পাননি। কারণ, প্রচারের ঢক্কানিনাদ ছিল না। কেন্দ্র বন্ধু সরকার ছিল, এমন নয়। বরং, নানা কাজে বাধা এসেছে বিস্তর। কখনও পাওনাগন্ডা নিয়ে দরকষাকষি করতে হয়েছে। রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমালোচনাও করতে হয়েছে। আবার প্রশাসকের চেয়ারে বসে কেন্দ্র–রাজ্য সম্পর্কের বিন্যাসেও নতুন মাত্রা এনেছেন। দুই দলের জোটই পাঁচ বছর টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
সেখানে এতগুলো দলকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার। অথচ, কোনও শরিকই নিজেদের বঞ্চিত বলতে পারবে না। বরং, যতখানি গুরুত্ব প্রাপ্য, তার থেকে বেশিই দিয়েছেন। এই উদারতা ও সমন্বয় আর কোথায় পাবেন! তাঁর আমলেও পাহাড় অশান্ত হয়েছিল। গোর্খাল্যান্ডের নামে হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। দক্ষ ও দূরদর্শী প্রশাসকের মতোই সামাল দিয়েছেন। পাহাড়ে শান্তি ফিরেছিল। কিন্তু ঢাক পিটিয়ে ‘পাহাড় হাসছে’ হোর্ডিং দিতে হয়নি। সেখানে উন্নয়নের কৃতিত্বের ভাগিদার হতে যাননি। সেই সময়েও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির কম চেষ্টা হয়নি। বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে সেই সময়েই। দেশের নানা প্রান্তে হয়েছিল দাঙ্গা। এই বাংলায় তার আঁচ পড়তে দেননি। প্রশাসকের নমনীয়তা ও দৃঢ়তা, দুটোই সেদিন দেখেছিল বাংলা। সবাইকে রাস্তায় নামিয়েছিলেন। একটা টিভি ইন্টারভিউতে জাভেদ আখতার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার রাজ্যে দাঙ্গা হয় না কেন? এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কিঁউ কি হুকুমত নেহি চাহতি।’ অর্থাৎ, প্রশাসন চায় না, তাই দাঙ্গা হয় না। ছোট্ট একটি বাক্য। কী বিশাল তার ব্যপ্তি। মনে পড়ছে নয়ের দশকের শেষ দিকে আরও একটি ছোট্ট ঘটনা। সেদিনই অযোধ্যায় বিশ্বহিন্দু পরিষদের মিটিং ছিল। যথারীতি হুঙ্কার ছাড়া হয়েছে। জ্যোতিবাবু মহাকরণ থেকে বেরিয়ে আসছেন। সাংবাদিকরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ঘোষণা করেছে, এক বছরের মধ্যে তারা রামমন্দির গড়বে। আপনরা প্রতিক্রিয়া? জ্যোতি বাবু থমকে দাঁড়ালেন। পাঞ্জাবি দিয়ে চশমা মুছতে মুছতে জানালেন, ‘আমি কী করব? মাথায় করে ইট বইব নাকি?’ বলেই গটগট করে এগিয়ে গেলেন লিফটের দিকে। ছোট্ট একটি বাক্য। কী মারাত্মক বার্তা লুকিয়ে আছে। সেদিন তাঁকে ‘লা আল্লা ইলাহি’ বলতে হয়নি। সেদিন তাঁকে চণ্ডীপাঠের মন্ত্র আওড়াতে হয়নি। নজরুলের কবিতাও বলতে হয়নি। সচেতন তাচ্ছিল্য দিয়েই রুখতে পেরেছিলেন সাম্প্রদায়িক প্রচার। কোন জেলায় কে সম্পাদক হবেন, কে কে কমিটিতে থাকবেন, সে ব্যাপারে মাথা গলানোর চেষ্টা করেননি। সংগঠন যাঁরা বোঝেন, তাঁদের হাতেই ছেড়ে রেখেছিলেন। তাই দল আর প্রশাসনকে আলাদা করতে পেরেছিলেন। কোনটা দলের মঞ্চে বলতে হয়, কোনটা প্রশাসনিক মঞ্চ থেকে বলতে নেই, এই পরিমিতি বোধটা ছিল। আবার কীভাবে দুর্নীতি আটকাতে হয়, সেটাও জানতেন। লোক দেখানো ভাষণে নয়, কাজে করে দেখিয়েছেন। শিক্ষক নিয়োগের নামে চালু করলেন স্কুল সার্ভিস কমিশন। স্বচ্ছভাবে শিক্ষক নিয়োগটাই হয়ে উঠল স্বাভাবিক রীতি। ঢাকঢোল পিটিয়ে বিজ্ঞাপন করতে হয়নি। এতবড় একটা সংস্কার যেন নিঃশব্দেই হয়ে গেল।S S C পরীক্ষা চালু হলো। ১৯৯৬। সারা দেশের বিজেপি বিরোধী সমস্ত দল একবাক্যে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাইল। তাঁর দল চাইলেই আর কোথাও কোনও বাধা ছিল না। দলের মধ্যেও দুদিন ধরে চলল বিতর্ক। শেষমেষ দলের সিদ্ধান্তই মেনে নিলেন অনুগত সৈনিকের মতো। (‌কষ্টকল্পনা হলেও একবার ভেবে দেখুন, সব আঞ্চলিক দল চাইছে, মমতা প্রধানমন্ত্রী হোন। অথচ, তৃণমূলের এমপি–‌রা বলছেন, আমরা সরকারে যাব না। পরিস্থিতিটা কী দাঁড়াত, শুধু একটু কল্পনা করুন।) প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবি থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। ভারতীয় রাজনীতিতে এমন উদাহরণ আর আছে!‌ ঠিক চার বছর পর। স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালেন মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকেও। এ দেশের রাজনীতিতে এমন উদাহরণও বিরল। ক্ষমতার শীর্ষ থেকে এভাবেও সরে যাওয়া যায়!‌ যায়, যদি তাঁর নাম জ্যোতি বসু হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় আচ্ছন্ন প্রজন্মের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, জ্যোতি বসু ঠিক কেমন ছিলেন। সিলেবাসেও নিজেকে ঢোকানোর চেষ্টা করেননি। নিজের কাজের ভিডিও করেও রাখেননি। ছবি তুলিয়েও রাখেননি। তাই ইউটিউব বা সবজান্তা গুগল ঘাঁটলেও বিরাট কিছু পাবেন না। ঢালাও বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচারের আনুকূল্যে জ্যোতি বাবুদের ভেসে থাকতে হয় না। তাঁরা থেকে যান কাজে। তাঁরা থেকে যান চেতনায়। ‘‌জ্যোতি বসু, ছোট্ট নাম, কী বিরাট ব্যক্তিত্ব’।

সংগৃহীত
লিখেছেনঃ স্বরূপ গোস্বামী 

1 comment:

  1. Otuloniyo Bakttito. Bharitiyo polictics der modhye sera. lekhoni ta o khub sunndar.

    ReplyDelete

Theme images by lishenjun. Powered by Blogger.