Header Ads

এনআরসির হুমকি বিজেপির জন্য বুমেরাং! মুখ ফেরানো ভোটারদের দখল কে পাবে কে? #SpecialArticle

অরুনাভ সেনঃ বিভাজন আর মেরুকরণ বাংলায় লোকসভা ভোটে বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে,অন্তত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন৷ প্রত্যাশিত ভাবে ফল বের হওয়ার পর দেখা গেল লাভের ফসল বিজেপিই ঘরে তুলেছে৷বুথ স্তরে দূর্বল সংগঠন,সত্যি বলতে কি সারা রাজ্যে বলার মত সংগঠন না থাকা সত্বেও, মেরুকরণ ও বিভাজন লোকসভায় বাংলায় ফ্যাক্টর না হলে তৃণমূলের সন্ত্রাস আর দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্য থেকে বিজেপি সাংসদ সংখ্যা কখনও ১৮তে পৌঁছত না৷যাই হোক ১৮ সাংসদ বাংলা থেকে, বঙ্গ বিজেপির জন্য সবটাই ছিল ফিল গুড৷পরিবেশ-পরিস্থিতি ছিল একেবারেই যেন তাদের পক্ষের মিষ্টি দখিনা হাওয়া৷কিন্তু রাজনীতিতে ঘাত-প্রতিঘাত থাকবে,সঠিক ইস্যুকে চিহ্নিত করতে পারা যেমন রাজনৈতিক নেতাদের দক্ষতা,বিচক্ষণতা,তেমনই সংবেদনশীল ইস্যুকে মানুষের কাছে হুমকিতে পরিণত করলে বড় ধস নামতে পারে নিজেদের ভোট ব্যাঙ্কে৷
এবং ঠিক সেই গোলটা বাঁধল অসমে,সেখানে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা বিজেপির প্রত্যাশিত ‘স্বপ্নপূরণ’-এ সহায়ক হলে আজ বিজেপির সব স্তরের নেতাদের এনআরসি নিয়ে ব্যাকফুটে যেতে হত না,বা বলা যেতেই পারে এত দ্রুত দলটির প্রতি মোহভঙ্গ হত না সেইসব মানুষদের যারা এই রাজ্যে চোখ বন্ধ করে বিজেপিতে ভোট দিয়েছিলেন৷ বলা বাহুল্য অসমের তালিকা প্রকাশের আগে বঙ্গ বিজেপির নেতারা যেভাবে এনআরসির পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, সত্যি কথা বলতে কি বাংলার অসংখ্য মানুষ সেটি স্রেফ থ্রেট হিসেবে দেখেছেন৷রাজ্যের অসংখ্য মানুষ যাদের শিকড় ওপার বাংলায়,অথচ দীর্ঘদিন ধরে ভারতে বসবাস করছেন,এখানেই জন্ম,লেখাপড়া শেখা,এমনকি সরকারি চাকরি করে অবসর নিয়েছেন,তারাও চরম মানসিক যন্ত্রনাবিদ্ধ পরিস্থিতির মুখে পড়লেন৷হয়ত এই অসহনীয় মানসিক যন্ত্রনা পরিস্থিতি আরও বেশ কয়েকগুন বাড়ত,যদি অসমে এনআরসির চুড়ান্ত তালিকা বিজেপির অনুকুল হত৷
অসমের চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জি বিজেপির সযত্নে লালিত এই রাজ্যেরও ভোটব্যাঙ্কের ভিত নড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।অথচ তার আগে থেকেই এনআরসির জন্য তাদের উচ্চস্বর মানুষের জন্য অসহনীয় মানসিক যন্ত্রনার পরিস্থিতি তৈরি করছিল৷আসলে বিজেপির নেতারা ভাবতে পারেন নি অসমে,চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জিতে যাঁদের নাম বাদ গেল তাদের একটি বড় অংশই বিজেপির কমিটেড ভোটার৷ যে লক্ষ্য সামনে রেখে এনআরসি চালু করার এত তোড়জোড় সেটাই বিজেপির জন্য বুমেরাং হতে চলেছে বেশ বোঝা যাচ্ছে৷আরও গোদা বাংলায় বললে যে ভোটব্যাঙ্কের জোরে রাজ্য থেকে ১৮সাংসদ বিজেপির৷সেই ভোটব্যাঙ্ককে এনআরসির হুমকি দিয়ে বিরাট বড় মাপের ভুলটা বিজেপি করে ফেলেছে৷এনআরসি বঙ্গ বিজেপির ক্ষেত্রে শুধু বুমেরাং হবে না,বলা বাহুল্য লোকসভায় যারা চোখ বন্ধ করে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন,তারাই উচ্চস্বরে বলছেন কি ভুলটাই না করেছি ওদের ভোট দিয়ে৷আর একটা ভোট আসতে দিন মানুষের মাথার উপর ছাদ কাড়ার হুমকি, আমরা দলটাকে বুঝিয়ে দেবো৷দলমত নির্বিশেষে বাংলার সব সংবেদনশীল মানুষ এনআরসির তীব্র বিরোধীতা করেছেন৷তাদের বক্তব্য কোনও একটা রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় এলে বাংলায় এনআরসি চালুর হুঙ্কার অসংখ্য মানুষকে মানসিকভাবে যন্ত্রনাবিদ্ধ করছে৷
এ এমন এক যন্ত্রনা যার উপশমের কোনও ওষুধ নেই,বরং আছে হঠাৎ করে গৃহহীন,রাষ্ট্রহীন,হওয়ার আশঙ্কা৷আছে ঘর-বাড়ি মাথার উপর নিজের ছাদ সহ সব হারাবার আশঙ্কা৷শুধুমাত্র ভোটের জন্য মানুষকে এত বিপদে ফেলার হুঁশিয়ারির মধ্যে কোন মানবিকতাবোধের রাজনীতি ছিল?এনআরসি ইস্যু ভবিষ্যতে বঙ্গ বিজেপির জন্য আত্মঘাতী হতে চলেছে৷মানুষকে ভয় দেখিয়ে ভোট মেলে না৷অনেক উদাহরন আছে৷রাজনীতিটা মানুষকে ভয় দেখানোর,আতঙ্কগ্রস্ত করার জন্য নয়৷রাজনীতির জন্য মানুষ নয়,বরং মানুষের কল্যাণসাধনের জন্য রাজনীতি৷মজার বিষয় রাজনীতি যেমন কোনও রাজনৈতিক দলকে দুহাত ভরে দেয়,কেড়েও নেয়৷১৮'র থেকে ৮ সংখ্যাটা জনগন কিন্তু যখন তখন কেড়ে নিতেই পারে৷ এনআরসি নিয়ে রাজ্য বিজেপি যখন ব্যাকফুটে সেই পরিস্থিতিতে কলকাতার নাগরিক পঞ্জি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ যা বলেছিলেন তার সারাংশ করলে বিষয়টি এমন হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) পাশ হয়ে আইন কার্যকর করার আগে এনআরসি করা হবে না৷কিন্তু প্রশ্ন, বাস্তবটা কী তাই?আমরা সবাই জানি ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে কিছু সংশোধন করতে চেয়ে ২০১৬ সালে নতুন বিল আনা হয়েছে। সেই বিল অনুযায়ী, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে চলে আসা হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন প্রভৃতি অ-মুসলিম ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা এ দেশে ‘অনুপ্রবেশকারী’ নন। তাঁরা শরণার্থী। হ্যাঁ সেখানেও সুস্পষ্ট মেরুকরন ও ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির নিদর্শন৷যদিও বিজেপি সেই রাজনীতি করে,এবং এই বিষয়ে তারা লুকোছাপা করে না,কিন্তু এখনকার আইন অনুযায়ী বিদেশ থেকে চলে আসা ব্যক্তিরা ভারতে ১১ বছর বাস করার পরেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন। সংশোধনী বিলে সেটি ১১ বছর কমিয়ে শুধুমাত্র ৬ বছর করার কথা বলা হয়েছে৷ অর্থাৎ, সংশোধনী কার্যকর হলে আরও কম সময়ের মধ্যে ভারতের নাগরিক হয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন ঐসব দেশ থেকে আসা নাগরিকরা৷
কিন্তু তার সঙ্গে কোথায় মিলছে এনআরসির সম্পর্ক? নাগরিকত্ব আইন সম্পূর্ন আলাদা বিষয়৷ কিন্তু এনআরসি? সেখানে তো এ দেশের নাগরিককেই নিজের ‘ভারতীয়ত্ব’ কাগজপত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। আর বংশপরম্পরার সেই সব নথি দাখিল করতে না-পারলে বা দাখিল করা সেই সব নথি যদি রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়, তবে আপনি,আমি বা আরও অন্যরা কেউ ভারতীয় নন বলে চিহ্নিত হতে পারেন! অসমে কিন্তু ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছে।এনআরসি হলে আমাদের ফের নাগরিকত্ব প্রমান করতে হবে নথি দিয়ে! ধরা গেল আমার বা আপনার কাছে যেসব নথিপত্র আছে সেগুলি আদৌ গ্রহণযোগ্য হল না! বিজেপির তরফে ড্যামেজ কট্রোলের জন্য বলা হচ্ছে সিএবি'র কথা৷তার জন্য নাকি অপেক্ষা করতে হবে মাত্র ৬ বছর!সেই সময়ে আপনার আসল অবস্থানটা কি!আপনি কি তখন আদৌ ভারতীয়!নাকি ‘অনুপ্রবেশকারী’! নাগরিত্বের অধিকার, বাড়ি, সম্পত্তি, চাকরি, ব্যবসা সবই তো চলে যাবে ঘোর অনিশ্চিত আর অনিশ্চিয়তার গহ্বরে! তার পরেও ঠিক কত দিনে সেই ‘নাগরিকত্ব’ পুণরায় ফিরে পাওয়া যাবে সেই প্রশ্ন না হয় আপাতত উহ্য থাকুক৷প্রতিবেশী রাজ্যে অসমে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়া মানুষদের ভবিষ্যতটা কিন্তু এখন ঠিক এমনই৷বাংলার শাসক তৃণমূল ইতিমধ্যে এনআরসির বিরোধীতা করেছে৷পিছিয়ে নেই বামেরাও৷তারাও ইতিমধ্যে এনআরসির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে,সভা-সমিতিতে এনআরসির বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন৷আসলে তৃণমূল এবং বামদলগুলি বুঝতে পারছে বাংলায় এনআরসির হুমকি বিজেপির জন্য বুমেরাং হয়ে ফিরতে চলেছে৷দুই দলের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে যারা লোকসভায় বিজেপিতে ভোট দিয়েছিলেন সেই ভোটারদের বিপুল অংশ নিশ্চিতভাবে আপাতত বিজেপিতে ভোট দেবেন না৷সবারই নজর এই ভোটব্যাঙ্ক নিজেদের ঝুলিতে ভরা৷হয়ত আগামীদিনে সেই লক্ষে পুনরায় তৃণমূলের সঙ্গে বাম দলগুলির রাজনৈতিক লড়াই আবার উপভোগ্য হয়ে উঠবে৷সেই পটভূমি তৈরি হয়েছে,অপেক্ষা শুধু সময়ের৷

No comments

Theme images by lishenjun. Powered by Blogger.