ডিএ, পে কমিশন আর কর্মসংস্থানে চা বিক্রি তো ‘মুখোশ’, প্রকৃত ‘মুখ’ আসলে কি? #Exclusive
অচ্যুত চন্দ্র (প্রতিনিধি ভারত চেম্বার অব কমার্স): সারা বাংলা এখন আবেগের বন্যায় ভেসে চলেছে বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের নোবেল বিজয়কে কেন্দ্র করে। কিন্তু ক’জন বাঙালি প্রকৃত অর্থে জানেন, অর্থনীতিকে তিনি সূক্ষাতি সূক্ষ কণায় ভেঙে তিনি ঠিক কী বলতে চেয়েছেন? ক’জন বাঙালি অনুভব করতে পারে, তাঁরা যে বাংলাকে নিয়ে মিনিটে দশবার গর্ব অনুভব করছেন সেই বাংলার অর্থনীতিরই ‘মুখোশ’ নয়, ‘মুখ’টা আসলে ঠিক কীরকম?
বিষয়টা অনেকটা গাছের যে ডালে বসেছি সেটাই কেটে ফেলার মতো। বাংলার অর্থনীতি আজ কোন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে জানতে বুঝতে গেলে, বেশ কিছু বিষয়ের মূলে প্রবেশ করতে হবে আমাদের। বিস্তারিত না হলেও একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে কিছুটা হলেও এখানে তাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হল-
গতসপ্তাহেই একটা কেটলি, ৫০০ খুরি(মাটির ভাঁড়) আর একটা টুল নিয়ে কোথাও একটা বসে পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন পশ্চিমবাংলার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী।চপ অথবা চা, চটজলদি জীবিকা নির্বাহের এহেন টোটকা তিনি মাঝেমধ্যেই দিয়ে থাকেন। তাঁর মতে, চায়ের দোকান খুললেই লোকজন রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়বে সেই দোকানে, আর এভাবেই চিরতরে দূর হয়ে যাবে বেকারত্ব দশা, বাংলার অর্থনীতিতেও এভাবেই আসবে সামগ্রিক উন্নয়ন। সরকার পক্ষের এই সহজ সমাধানসূত্র এককথায় অভাবনীয়। সমাজের যেকোনও সমস্যারই সমাধানসূত্র বলে দিতে পারেন তাঁরা। উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই বলা যেতে পারে, সরকারি কর্মচারীদের ছুটি সংক্রান্ত বিষয়। সরকারী কর্মচারীদের নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্য সরকারপক্ষ লম্বা ছুটির ঘোষনা করেছেন, অর্থাৎ দিওয়ালি বা দীপাবলি পালন করতে গিয়ে কোনও সরকারি কর্মচারী যদি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, এই ভাবনা থেকে তাদের জন্য ভাইফোঁটার আগে-পরে ছুটির ব্যবস্থা করা হয়েছে, এমনকি ছুটি দেওয়া হয়েছে ছট পুজোর জন্যেও, যেখানে বিহার সরকার তাঁদের কর্মচারীদের ছট পুজো উপলক্ষে কোনও ছুটি ঘোষনা করেননি। এ ছুটি নিখাদ ছুটি, নাকি নেপথ্যে রয়েছে অন্য গল্প?
‘ডিএ’। এ নিয়ে জলঘোলার অন্ত নেই। একটি ট্রাইবুনাল(স্যাট)-এ আগামী তিন মাসের মধ্যে ডিএ বাস্তবায়নের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে, যার সময়সীমা নাকি গত সপ্তাহেই সমাপ্ত হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে কি চুপ থাকাটাই শ্রেয়? বিষয়টা যা দাঁড়াচ্ছে, তা হল… চিরাচরিতভাবে কর্মচারীদের দল নায্য দাবি আদায়ে আদালতের শরণাপন্ন হবে এবং সরকারপক্ষ চটজলদি মামলার রফা করতে অথবা ‘সহজ সমাধান’-এর জন্য আইনি খাতে একগাদা টাকা খরচ করে যাবেন। ফলত, এসব ঝামেলা এড়াতে বা ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে’ ছুটির উপর ছুটি দাও।
সময়টা ঘুমিয়ে থাকার নয়। আমাদের রাজ্য যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর উপর অবস্থান করছে সে বিষয়ে জাগ্রত হবার প্রয়োজন এসেছে। সমস্যার ভিত্তির দিকে ঘুরে তাকাতে হবে। অর্থনীতির পরিকাঠামোগত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই কিছু ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক ঘটনার উপর আলোকপাত করতে হবে। জানা যায়, মুঘল সাম্রাজ্যের সারাবিশ্বে জিডিপিতে ২৫% অবদান ছিল এবং বাংলায় তাদের অবদান ছিল ৫০%। জনসংখ্যার নিরিখে সারাভারতে বিহারের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘনত্বের অধিকারী বাংলা। ক্ষুদ্র ভৌগলিক পরিসরে এত বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে শিল্পায়নের জন্য বড় জমি খুঁজে পাওয়াটা রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জের তো বটেই। তাহলে কি ধরে নেওয়া যেতে পারে, ১৯৬০-এ পর্যন্ত বাংলা যে আলোর সম্মুখীন হতে পেরেছিল, তা এবার পুরোপুরি নিভে যেতে বসেছে? বারবার সরকার বদল হয়, তাঁরা বিশাল বিশাল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু বাস্তবায়ন চোখে পড়েনা।
আমরা অতীতে ঘটে যাওয়া সিঙ্গুরের ঘটনাই উল্লেখ করতে পারি। টাটাদের সিঙ্গুর জরুরী অবস্থান গ্রহন কর বিশ্বের দরবারে। ব্যাস, তারপর? যখন রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকে তখন তখন ‘সিঙ্গুর সিঙ্গুর’ রব ওঠে, আবার তা মিলিয়ে যায়।
কয়েক দশক ধরে এই ‘হাইপার পলিটিক্যাল ইস্যু’ নিয়ে নানা মুনি নানা মত পরিবেশন করে চলেছেন। বিস্তর তর্ক-বিতর্ক চলে এখনও। কিন্তু, সিঙ্গুরের ঠিক/ভুল নিয়ে নিজেদের বিচার শুনানির আগে কয়েকটি মূল সমস্যার গোরায় পৌঁছানো দরকার। সর্বশেষ বাম সরকার, অর্থাৎ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার প্রকৃতপক্ষে শিল্পে বিনিয়োগ আনাইয় উদ্যোগী হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটু বেশি নম্বর পাওয়ার তাড়াহুড়োয় বিতর্কিতভাবে, বিতর্কিত শর্তসাপেক্ষে ২০১১-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে টাটাকে কলকাতা থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে জমি দেন তাঁরা।
এদিকে, মনে করা হয় বাংলার জমি চাষাবাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী, শুধু তাই নয়, সর্বাপেক্ষা ধানের উৎপাদনস্থল এবং ফলমূল-শাকসব্জি ফলনের নির্ভোরযোগ্য জমি হিসেবেও বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর বাংলার ফসল ফলানোর সবচেয়ে উপযুক্ত অংশ হল দক্ষিণ বাংলা। তার গা ঘেঁষেই তিন শতক আগে ব্রিটিশদের দ্বারা পত্তন হয় কলকাতা নগরীর, যা সবসময় ফুঁসছে নিজেকে ‘বাণিজ্যনগরী’ প্রমানের জন্য। ক্ষমতায় আসা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকারপক্ষ বহুবার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প আনার চেষ্টায় উদ্যোগী হয়েছে, অনেকটা ‘ট্রেন্ডি ফ্যাশন’এর মতো। এখন যদিও আর্থিক উন্নয়নের কথা ফলাও করে বলা হয়, তবুও এ রাজ্যের এখন সবচেয়ে প্রয়োজন গণবেকারত্ব দূরীকরণের, একটা সুস্থ চাকরির।তাহলে, উর্বর জমি ধ্বংসের মাধ্যমে বিনোয়গ শিল্পায়ণ কি ন্যায়সঙ্গত? প্রশ্নটা থেকেই যায়। বর্তমান সরকার দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পাশের সিঙ্গুর অঞ্চলকে শিল্পাঞ্চল হিসেবে ঘোষনা করার জন্য এমএসএমই ইউনিট দ্বারা একাধিক উর্বর অঞ্চলকে ব্যাপকভাবে একীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও ইউনিটগুলির কোনও দীর্ঘমেয়াদী বাস্তব মূল্যায়ণ এখনও করা হয়নি।
অন্যদিকে, শুষ্ক আবহাওয়াপ্রবন শালবনি, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া-র মতো অঞ্চলগুলিতে শিল্পায়ন বা কৃষি-অর্থনীতির কোনও লাভ হয়নি, যার ফলস্বরূপ আমরা কিছু বছর আগে পর্যন্ত চরম দারিদ্র এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রত্যক্ষ করেছি সেখানে।এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় পরিসংখ্যান তথ্য পর্যবেক্ষণ করলে আমাদের চোখ খুলে যেতে পারে।
২০১৭ সালের ভারত সরকারের একটি রেকর্ড-এ দেখা যায়, জিডিপি অনুসারে শিল্পোৎপাদনে ২৫.৮০% এবং কর্মসংস্থানে ২৩.৭৯% অবদান ছিল, যেখানে জিডিপি অনুসারে কৃষিক্ষেত্রে ১৭.৪০ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানে ৪২.৭৪% অবদান ছিল। যেহেতু দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা ৩ বিলিয়ন এবং এর অর্ধেকের বেশি ৩০ বছরের কম বয়সী, এক্ষেত্রে সামাজিক শান্তি ও সন্তুষ্টি বজায় রাখা একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের হয়ে উঠেছে এবং এই পরিস্থিতির সামাল দিতে পারে একমাত্র ‘কর্মসংস্থান’ই।
প্রকৃত অর্থে জনগনের জন্য কর্মসংস্থান, বেঁচে থাকা ও খাদ্যসংস্থানের আশ্বাসটুকু দেওয়ার জন্য অন্ততপক্ষে পরবর্তী ৫০ বছরের অর্থনীতি নিয়ে একটি গভীর চিন্তাভাবনা থাকা আবশ্যিক। ১৯৬০-এর দশকের মতো অশান্ত সামাজিক প্রেক্ষাপট আমরা কি আবার ফিরে পেতে চাইব? বর্তমান প্রজন্মের থেকে শস্য-শ্যামল পরিবেশ কেড়ে নেওয়া এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মৌলিক খাদ্যের জন্য অন্ধকারের সঙ্গে লড়ায়েই মুখে ঠেলে দেওয়াটা নিঃসন্দেহে গুরুতর অপরাধ।তাই বিকল্প কিছু আমাদের ভাবতেই হবে। অপেক্ষাকৃত কম উর্বর অঞ্চলগুলিকে আমরা শিল্পোন্নোয়নের জন্য বেছে নিতেই পারি। তবে এক্ষেত্রে একটি অজুহাত সবসময় প্রস্তুত থাকে, সেটি হল- শিল্পপতি মূল শহর বা বন্দর থেকে বেশিই দূরে যেতে চান না।যদিও এই ধারনা সম্পূর্ণ ‘মিথ’, তার কারণ, আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, পুনে, নাসিক ও নাগপুরের মতো শিল্পপ্রধান শহরগুলি কিন্তু মুম্বই থেকে বেশ দুরত্বে অবস্থান করে। তাই কলকাতা থেকে দূরে শালবনি বা পুরুলিয়ার মতো অঞ্চলগুলিকে শিল্পক্ষেত্রের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়াই যায়। এবার, শিল্পপতিদের উপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ানো, শিল্পের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী, অর্থাৎ রাস্তাঘাট, জল, বিদ্যুৎ -এসবের পর্যাপ্ত যোগানের নেপথ্যে কোন রাজনৈতিক অভিসন্ধি কাজ করছে তা লক্ষ্যনীয়।
তাই, কিছু অস্বচ্ছ দর্শনের ভিত্তিতে সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতি ধ্বংসসাধনের আগে দু’বার ভাবুন। ধ্বংস না করে, যা আছে সেটাই কীভাবে উপযুক্ত করে তোলা সম্ভব, তার উপায় ভাবা দরকার। কৃষিক্ষেত্রগুলিকে আধুনিকীকরনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মাথা পিছু আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরীর কথাই ভাবতে হবে। কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে কৃষিক্ষেত্রের সহ-অংশীদার করতে হবে, কৃষিকে ধ্বংস না করেই। মনে রাখতে হবে মোগল থেকে ব্রিটিশ জমানায় ফুলেফেঁপে ওঠা রাজকোষের মূল কারিগর ছিল এই বানিজ্যিক রাজধানীর বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। যদিও আজকের অর্থনীতিতে তৎকালীন নদী বন্দরগুলি আর কার্যকর নয়।
বিষয়টা অনেকটা গাছের যে ডালে বসেছি সেটাই কেটে ফেলার মতো। বাংলার অর্থনীতি আজ কোন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে জানতে বুঝতে গেলে, বেশ কিছু বিষয়ের মূলে প্রবেশ করতে হবে আমাদের। বিস্তারিত না হলেও একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে কিছুটা হলেও এখানে তাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হল-
গতসপ্তাহেই একটা কেটলি, ৫০০ খুরি(মাটির ভাঁড়) আর একটা টুল নিয়ে কোথাও একটা বসে পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন পশ্চিমবাংলার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী।চপ অথবা চা, চটজলদি জীবিকা নির্বাহের এহেন টোটকা তিনি মাঝেমধ্যেই দিয়ে থাকেন। তাঁর মতে, চায়ের দোকান খুললেই লোকজন রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়বে সেই দোকানে, আর এভাবেই চিরতরে দূর হয়ে যাবে বেকারত্ব দশা, বাংলার অর্থনীতিতেও এভাবেই আসবে সামগ্রিক উন্নয়ন। সরকার পক্ষের এই সহজ সমাধানসূত্র এককথায় অভাবনীয়। সমাজের যেকোনও সমস্যারই সমাধানসূত্র বলে দিতে পারেন তাঁরা। উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই বলা যেতে পারে, সরকারি কর্মচারীদের ছুটি সংক্রান্ত বিষয়। সরকারী কর্মচারীদের নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্য সরকারপক্ষ লম্বা ছুটির ঘোষনা করেছেন, অর্থাৎ দিওয়ালি বা দীপাবলি পালন করতে গিয়ে কোনও সরকারি কর্মচারী যদি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, এই ভাবনা থেকে তাদের জন্য ভাইফোঁটার আগে-পরে ছুটির ব্যবস্থা করা হয়েছে, এমনকি ছুটি দেওয়া হয়েছে ছট পুজোর জন্যেও, যেখানে বিহার সরকার তাঁদের কর্মচারীদের ছট পুজো উপলক্ষে কোনও ছুটি ঘোষনা করেননি। এ ছুটি নিখাদ ছুটি, নাকি নেপথ্যে রয়েছে অন্য গল্প?
সময়টা ঘুমিয়ে থাকার নয়। আমাদের রাজ্য যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর উপর অবস্থান করছে সে বিষয়ে জাগ্রত হবার প্রয়োজন এসেছে। সমস্যার ভিত্তির দিকে ঘুরে তাকাতে হবে। অর্থনীতির পরিকাঠামোগত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই কিছু ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক ঘটনার উপর আলোকপাত করতে হবে। জানা যায়, মুঘল সাম্রাজ্যের সারাবিশ্বে জিডিপিতে ২৫% অবদান ছিল এবং বাংলায় তাদের অবদান ছিল ৫০%। জনসংখ্যার নিরিখে সারাভারতে বিহারের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘনত্বের অধিকারী বাংলা। ক্ষুদ্র ভৌগলিক পরিসরে এত বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে শিল্পায়নের জন্য বড় জমি খুঁজে পাওয়াটা রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জের তো বটেই। তাহলে কি ধরে নেওয়া যেতে পারে, ১৯৬০-এ পর্যন্ত বাংলা যে আলোর সম্মুখীন হতে পেরেছিল, তা এবার পুরোপুরি নিভে যেতে বসেছে? বারবার সরকার বদল হয়, তাঁরা বিশাল বিশাল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু বাস্তবায়ন চোখে পড়েনা।
আমরা অতীতে ঘটে যাওয়া সিঙ্গুরের ঘটনাই উল্লেখ করতে পারি। টাটাদের সিঙ্গুর জরুরী অবস্থান গ্রহন কর বিশ্বের দরবারে। ব্যাস, তারপর? যখন রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকে তখন তখন ‘সিঙ্গুর সিঙ্গুর’ রব ওঠে, আবার তা মিলিয়ে যায়।
কয়েক দশক ধরে এই ‘হাইপার পলিটিক্যাল ইস্যু’ নিয়ে নানা মুনি নানা মত পরিবেশন করে চলেছেন। বিস্তর তর্ক-বিতর্ক চলে এখনও। কিন্তু, সিঙ্গুরের ঠিক/ভুল নিয়ে নিজেদের বিচার শুনানির আগে কয়েকটি মূল সমস্যার গোরায় পৌঁছানো দরকার। সর্বশেষ বাম সরকার, অর্থাৎ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার প্রকৃতপক্ষে শিল্পে বিনিয়োগ আনাইয় উদ্যোগী হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটু বেশি নম্বর পাওয়ার তাড়াহুড়োয় বিতর্কিতভাবে, বিতর্কিত শর্তসাপেক্ষে ২০১১-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে টাটাকে কলকাতা থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে জমি দেন তাঁরা।
এদিকে, মনে করা হয় বাংলার জমি চাষাবাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী, শুধু তাই নয়, সর্বাপেক্ষা ধানের উৎপাদনস্থল এবং ফলমূল-শাকসব্জি ফলনের নির্ভোরযোগ্য জমি হিসেবেও বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর বাংলার ফসল ফলানোর সবচেয়ে উপযুক্ত অংশ হল দক্ষিণ বাংলা। তার গা ঘেঁষেই তিন শতক আগে ব্রিটিশদের দ্বারা পত্তন হয় কলকাতা নগরীর, যা সবসময় ফুঁসছে নিজেকে ‘বাণিজ্যনগরী’ প্রমানের জন্য। ক্ষমতায় আসা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকারপক্ষ বহুবার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প আনার চেষ্টায় উদ্যোগী হয়েছে, অনেকটা ‘ট্রেন্ডি ফ্যাশন’এর মতো। এখন যদিও আর্থিক উন্নয়নের কথা ফলাও করে বলা হয়, তবুও এ রাজ্যের এখন সবচেয়ে প্রয়োজন গণবেকারত্ব দূরীকরণের, একটা সুস্থ চাকরির।তাহলে, উর্বর জমি ধ্বংসের মাধ্যমে বিনোয়গ শিল্পায়ণ কি ন্যায়সঙ্গত? প্রশ্নটা থেকেই যায়। বর্তমান সরকার দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পাশের সিঙ্গুর অঞ্চলকে শিল্পাঞ্চল হিসেবে ঘোষনা করার জন্য এমএসএমই ইউনিট দ্বারা একাধিক উর্বর অঞ্চলকে ব্যাপকভাবে একীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও ইউনিটগুলির কোনও দীর্ঘমেয়াদী বাস্তব মূল্যায়ণ এখনও করা হয়নি।
অন্যদিকে, শুষ্ক আবহাওয়াপ্রবন শালবনি, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া-র মতো অঞ্চলগুলিতে শিল্পায়ন বা কৃষি-অর্থনীতির কোনও লাভ হয়নি, যার ফলস্বরূপ আমরা কিছু বছর আগে পর্যন্ত চরম দারিদ্র এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রত্যক্ষ করেছি সেখানে।এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় পরিসংখ্যান তথ্য পর্যবেক্ষণ করলে আমাদের চোখ খুলে যেতে পারে।
২০১৭ সালের ভারত সরকারের একটি রেকর্ড-এ দেখা যায়, জিডিপি অনুসারে শিল্পোৎপাদনে ২৫.৮০% এবং কর্মসংস্থানে ২৩.৭৯% অবদান ছিল, যেখানে জিডিপি অনুসারে কৃষিক্ষেত্রে ১৭.৪০ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানে ৪২.৭৪% অবদান ছিল। যেহেতু দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা ৩ বিলিয়ন এবং এর অর্ধেকের বেশি ৩০ বছরের কম বয়সী, এক্ষেত্রে সামাজিক শান্তি ও সন্তুষ্টি বজায় রাখা একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের হয়ে উঠেছে এবং এই পরিস্থিতির সামাল দিতে পারে একমাত্র ‘কর্মসংস্থান’ই।
তাই, কিছু অস্বচ্ছ দর্শনের ভিত্তিতে সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতি ধ্বংসসাধনের আগে দু’বার ভাবুন। ধ্বংস না করে, যা আছে সেটাই কীভাবে উপযুক্ত করে তোলা সম্ভব, তার উপায় ভাবা দরকার। কৃষিক্ষেত্রগুলিকে আধুনিকীকরনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মাথা পিছু আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরীর কথাই ভাবতে হবে। কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে কৃষিক্ষেত্রের সহ-অংশীদার করতে হবে, কৃষিকে ধ্বংস না করেই। মনে রাখতে হবে মোগল থেকে ব্রিটিশ জমানায় ফুলেফেঁপে ওঠা রাজকোষের মূল কারিগর ছিল এই বানিজ্যিক রাজধানীর বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। যদিও আজকের অর্থনীতিতে তৎকালীন নদী বন্দরগুলি আর কার্যকর নয়।
Loading...
কোন মন্তব্য নেই