"সিরিয়ার রাস্তা"... অধ্যাপক কমল নাগ
অধ্যাপক কমল নাগ
কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটি ছেলে হটাত পথের মাঝে হাত তুলে আমাকে দাঁড়াতে বলল । বাইকের গতি কমিয়ে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে দাড়াতেই ছেলেটি দৌড়ে এসে বলল- “কাকু, সিরিয়া যাবেন?” আমি তো হতভম্ব হলাম। এই বাজাজ প্লাতিনা বাইক নিয়ে কিভাবে সিরিয়া যাব; আর ছেলেটিই বা কিভাবে সিরিয়া থেকে কাথি এল। বেটে খাটো গোছের দশ কি বার বছর বয়স, স্কুল উনিফরম পরা ছেলেটি বলল-” কাকু, বেশি দূর নয়, নিয়ে চলুন না। নামালের পরেই সিরিয়া, গাড়ি পাচ্ছি না।” এইবার আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম- যাইহোক আরবের সিরিয়া নয়, এই সিরিয়া কাথি র আশেপাশের কোন গ্রাম হবে। ছেলেটি আবার অনুনয় করতেই তার মুখের দিকে ভাল করে তাকালাম। একরাশ নস্টালজিয়া ঘিরে ধরল। ছেলেটি যেন অতিতের স্কুল শেশের ক্লান্ত আমি আর বাইকে বসে থাকা আমি রাস্তার অচেনা কাকু যাকে আমিও লিফট চাইতাম। যাইহোক শেষমেশ ছেলেটিকে বললাম- আমি কিন্ত রাস্তা চিনি না। তুই দেখিয়ে দিলে নিয়ে যাব। সে একরাশ নির্মল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল-”ঠিক আছে”। তারপর আমার বাইকে চড়ে বসল। আমি তাকে নিয়ে চললাম সিরিয়ার পথে। বেশ কিছুদুর বাক্যালাপ ছাড়াই চলার পর জিজ্ঞেস করলাম- কোন ক্লাসে পড়িস? ছেলেটি বলল-“ক্লাস সিক্স কাকু।”
তুই জানিস সিরিয়া নামের একটা দেশ আছে , সেখানে ভীষণ যুদ্ধ চলছে। ছেলেটি জিজ্ঞেস করল- “কেন?” আমি বললাম- কে রাজা হবে সেই নিয়ে। তারপর সে বলতে থাকলো- “তাহলে তো সেখানে অনেক ঘোড়া আছে, সবাই ঘোড়ার পিঠে চেপে তলয়ার নিয়ে যুদ্ধ করে।” আমি বললাম – না রে , এখন উড়োজাহাজ থেকে বোমা ফেলে যুদ্ধ হয়। সে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল-”কাকু, স্কুলের ওপরেও তো বোমা পড়তে পারে।” আমি হতচকিত হয়ে বললাম- হ্যাঁ পরতে পারে। তারপর দুজনেই নীরবে বেশ কিছুক্ষন। বাইকের গতি বাড়ালাম, পেরিয়ে গেলাম অনেকটা পথ সিরিয়ার দিকে। হটাত ছেলেটি বলে উঠল -”কাকু, আমার গ্রাম টা পেরিয়ে এসেছি। তুমি আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও।” আমি বললাম -সে কি রে তুই যে বললি রাস্তা দেখিয়ে দিবি। ছেলেটির নির্মল হাসসজ্জল মুখ যেন কিছুটা ভীত। আমি বললাম-কি হয়েছে? সে বলল- “বাবা বলছিল আমাদেরও নাকি যুদ্ধ হবে। তাহলে তো আমার স্কুলএও.........।”
এই বলে সে হাঁটতে শুরু করল। আমি নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম সিরিয়ার ওই ছেলেটির দিকে। সে আমাকে সিরিয়ার রাস্তা দেখাল না, হয়ত পৃথিবীর কোন শিশুই কাওকে কোনদিন সিরিয়ার রাস্তা দেখাতে চাইনি। সে রাস্তা আমরা তৈরি করেছি। বোমারু বিমান দিয়ে আমারা ভেঙ্গে ফেলেছি আনেক স্কুল, মেরে ফেলেছি অনেক শৈশব। এইসব ভাবতে ভাবতে কেমন যেন একটা ঘোর এল। হটাত নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে থেকে আজানের সুর। অনুভব করলাম অনেকটা সময় বোকার মত রাস্তার ধারে দাড়িয়ে আছি। বাসায় আনেক কাজ পড়ে আছে। বাইকে স্টার্ট দেবার আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম- হে ঈশ্বর ... আমার দেশের এই সিরিয়াকে যেন যুদ্ধ দেখতে না হয়, যেন সিরিয়ার পথেও স্কুল ফেরত শিশুরা নির্ভয়ে তাদের গ্রামে ফেরে আবার।
লেখকঃ কমল নাগ
সহ অধ্যাপক
পি কে কলেজ
কন্টাই, পূর্ব মেদিনীপুর
Loading...
কোন মন্তব্য নেই