Header Ads

সেকালের হাতে খড়ি, একালের হাতে খড়ি।

নজরবন্দিঃ সেবার দেশে একটা দাওয়াত পাই। হাতে খড়ির অনুষ্ঠান। মেয়ের মা নিজে ফোন করেছে। - দাদা, আপনি দেশে এসেছেন, আর আমার মেয়ের হাতে খড়ি। আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে। কোন কথা শুনব না। স্কুলের ছোট বোন। বড় দাবী নিয়ে দাদা বলে ডাকে। বোনের এমন ভালবাসার ডাক এড়াই কেমন করে? বলি; - আচ্ছা আসব। - ওহ্ দাদা, আমার যে কি ভাল লাগছে! আপনার হাতেই আমার মেয়ের হাতে খড়ি হবে!

- আমি তো তেমন কেউ নই রে! কোন ভাল টিচারের হাতে হাতে খড়ি দে। - আপনার চেয়ে ভাল টিচার আমি জীবনে দেখিনি। আপনার মনে আছে দাদা? এক মাসে আমাদের ফিজিক্স বই পড়িয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন? - হুম, মনে আছে। মনে পড়ে, ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে বেকার বসে আছি। একদিন স্কুলে যাই। হেড স্যার বললেন; - আফতাব উদ্দীন, আজ ফিজিক্সের টিচার আসেনি। তুই ক্লাস টেনের ক্লাসটা নে। হেড স্যার কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে আমাকে আফতাব হোসেন না ডেকে আফতাব উদ্দীন ডাকতেন। ভালবাসতেন আপন ছেলের মত। তার আদেশ শিরোধার্য। পড়াতে আমার বরাবরই ভাল লাগে। তার উপর ফিজিক্স আমার প্রিয় সাবজেক্ট। ক্লাসে যেয়ে দেখি ফিজিক্সের ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। সেই শুরু। প্রতিদিন পড়িয়ে একমাসেই শেষ করেছিলাম ফিজিক্স। ও সেই ক্লাসেরই একজন। ত্রিশ বছর ধরে প্রবাসে থাকি। এখন হাতে খড়ি কিভাবে হয় জানি না। আমাদের সময় হাতে খড়ি হত শ্লেট আর খড়িমাটি (চক) দিয়ে। খড়িমাটি দিয়ে প্রথম লেখা শুরু হত বলেই হয়ত নাম হয়েছিল হাতেখড়ি। মনে পড়ে পঞ্চাশ বছর আগে আমরও হাতে খড়ি হয়েছিল। তবে অন্য ভাবে। গ্রামে। মামা বাড়ীতে। নানা আমার জন্য একটা লাল জামা আর কোমরে রাবার দেয়া হাফ প্যান্ট কিনে আনলেন। সকাল বেলা আমি নেয়ে ধুয়ে নতুন জামা পড়ে তৈরী। দিলু মামা তাল পাতা কেটে আনলেন। সেই পাতার শিরদাঁড়া ফেলে দিয়ে সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা হল।
নানী নারকেলের ছোবড়া পুড়িয়ে কালো ছাই বানালেন। একটা পুরনো কালির দোয়াতে সেই ছাই পানিতে গুলিয়ে তৈরী হল কালি। বাঁশের কঞ্চি কেটে এক মাথা সুঁচালো করে বানানো হল কলম। আমি অবাক চোখে বড়দের এই অদ্ভূত কান্ড কারখানা দেখছি। আর ভাবছি, কাগজ কলম না এনে এসব ছাই পাতা জড়ো করছে কেন? সকাল থেকে আমাকে কিছু খেতে দেয়া হয়নি। খিধেয় পেট আমার চো চো করছে। তার উপর নানী তিন দিনের দুধ জমিয়ে, খেজুরের রস দিয়ে যে পায়েস রেঁধেছেন, তার মৌ মৌ গন্ধে পেটে আমার হাজার ছুঁচোর ছোটাছুটি। আমি খিধে পেটে জামাই সেজে ছোট হোগলা পেতে বসে আছি। কখন পণ্ডিত মশাই আসবেন। পাঁচ গাঁয়ের একমাত্র স্কুল তেওলা স্কুল। সেই স্কুলের বুড়ো পন্ডিত। নাড়ু পন্ডিত। তার আসল নাম কি জানা হয়নি কখনো। মাথা সব সময় ন্যাড়া করে রাখতেন। তাই সবাই ডাকত নাড়ু পণ্ডিত। তাকে খবর দেয়া দেয়া হয়েছে। জনশ্রুতি আছে, নাড়ু পণ্ডিতের সাথে নাকি মা সরস্বতীর সরাসরি যোগাযোগ। যেই তার হাতে হাতে খড়ি নেবে, দেবী সরস্বতীর বর তার উপর নিশ্চিত বর্ষাবে। শুনেছি, নানা এবং মারও এই নাড়ু পণ্ডিতের কাছেই হাতে খড়ি হয়েছিল। যদিও দুজনের কেউই প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডী পেরোননি! আমার কপালে কি আছে কে জানে? বেশ বেলা করেই নাড়ু পণ্ডিত এলেন। ভেবেছিলাম, ঋষি মুনি টাইপের কেউ হবে। পণ্ডিত মশাই আমার সে আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিলেন। তেল চপচপে টাক মাথা। তার নাম তো নাড়ু পণ্ডিত না হয়ে টাকু পণ্ডিত হওয়া উচিত ছিল। মুখে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি। গায়ে ধূসর রঙের ফতুয়া। রঙ হয়ত এক সময় সাদাই ছিল! কালের বিবর্তনে ধুসর রঙ ধারণ করেছে। পরনের ময়লা ধুতিটা হাঁটু পর্যন্ত তোলা। ধুলো মলিন পাদুটোয় জুতা বা স্যান্ডেল নেই কোনো। তাকে দেখেই মা ছুটে গেলেন এক বদনা পানি নিয়ে। মাকে দেখেই ফোকলা মুখে হেসে খনখনে গলায় বলে ওঠে পণ্ডিত মশাই; - বদনাডা মোরে দেও মা। পাও দুইডা দুই। শুবো কাম পবিত্র অইয়া করতে অয়। মা শুনলেন না।
পরম ভক্তি ভরে তার শৈশবের শিক্ষা গুরুর পায়ে পানি ঢেলে দিলেন। পণ্ডিত মশাই এক পা দিয়ে অন্য পা ডলে ডলে ধুলেন। তার জন্য জল চৌকি পাতা হল। তিনি আসন গ্রহণ করলেন। অন্যান্য মামা খালারাও লাইন দিয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। তবে নানাকেও তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। মা শিখিয়েছেন, বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হয়। বড়রাও যে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে জানা ছিল না। সবার দেখাদেখি আমিও পণ্ডিত মশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে পণ্ডিত মশাই বললেন; - নুরজাহান, তোর পোলাডা তো এক্কারে দেব শিশুর নাহান। নানা বললেন; - পণ্ডিত মশাই, এট্টা কিছু মোহে দিয়া লয়েন। - তোমাগো মোছোলমানের এইর ফান্নেই কিছু অয় না। খালি খাই খাই হরো। আগে পাতা আনো। আগে থেক কেটে রাখা তালপাতা তার হাতে দেয়া হল। পণ্ডিত মশাই একটি তারকাটা দিয়ে চেপে চেপে গোটা গোটা করে লিখলেন, অ আ, ক খ, স্বর বর্ণ, ব্যঞ্জন বর্ণ। কয়েকটা পাতায় লিখে মার হাতে দিলেন। মা দ্রুত পাতাগুলো আগে থেকেই চুলোয় বসানো এক হাড়ি ফুটন্ত পানিতে ডুবিয়ে দিলেন। আব্বা অনেকক্ষণ ধরেই একপাশে চেয়ার পেতে বসে আছেন চুপ চাপ। মুখে যথারীতি পান। আজ আব্বা খুব একটা কথা বলছেন না। তবে মুখটা বেশ হাসি হাসি। কয়েক মিনিটের মধ্যে পানিতে ফুটে তালপাতাগুলো নরম হয়ে গেল।
এবার ওগুলোকে উঠোনে শুকাতে দেয়া হল। বাড়ির সব বউ ঝি, ছেলে মেয়েরা গোল হয়ে দাড়িয়ে আমার হাতেখড়ি দেখছে। বাড়িতে কেমন যেন এক উৎসবের আমেজ। শীতের রোদ সকালের মিঠেকড়া ভাব ছেড়ে তেতে উঠতে শুরু করেছে। নানা আবার বললেন; - পণ্ডিত মশাই, পাতা হুগাইতে তো সময় লাগবে। এট্টু নাস্তা পানি হরেন। - মোছোলমানের গরে অন্ন গেরহোন শাস্তরে মানা আছে, খোনহার। নানার নাম আলী আহম্মদ খন্দকার। সবাই ডাকে খোনহার সাইব। তো, খোনহার সাইব তার পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হেসে বললেন, - হে হে হে পন্ডিত মশাই। দুধ আর খাজুরের মিডার সিন্নী রানছে। ওয়া খাইলে কিছু অইবে না। মুখ মিডা না হরলে কি আতেখরি অয়? -তোমরা দেহি আমার জাত না মাইর্রা ছারবা না! অল্ফো দিও। বারি যাইয়া আবার পেষ্চিত্তো হরতে অইবে। বিশাল এক কাশার থালায় অনেকখানি ঘন দুধের খিড়, তার পাশে হাট থেকে আব্বার আনা অনেকগুলো বাতাশা আর দানাদার সাজিয়ে তাকে দেয়া হল। পন্ডিত মশাই থালার চারিদিকে একটু পানি ছিটিয়ে দূগ্গা দূগ্গা বলে খেতে শুরু করলেন। খাওয়া দেখে মনে হল, আমার মত তারও বোধহয় সকাল থেকে পেটে কোন দানা পানি পড়েনি। আমাকেও বাটি ভরে খিড় দেয়া হল। বাড়ীর সবাইকে বিলানো হল গুড়ের বাতাশা। কি যে স্বাদ সেই বাতাশার। মুখে দিতেই মোমের মত গলে যেত। কোথায় হাড়িয়ে গেছে গ্রাম বাংলার সেই কৃষ্টি, পূজা পার্বনে, আচার অনুষ্ঠানে, টিনের চালে বাতাশার বৃষ্টি। আহা! কতকাল বাতাশা খাই না!

খেয়ে দেয়ে শব্দ করে ঢেকুর তোলেন বৃদ্ধ পন্ডিত। ফতুয়ার খোঁটে মুখ মুছে বললেন- সিন্নীডা জম্মের মজা অইছে। থাকলে এট্টু ঠাউরানের ফান্নে দিও। আমাদের খাওয়া শেষ হতে হতে তেজি রোদে পাতাও শুকিয়ে গেল। আমাকে বুড়ো পন্ডিতের কোলের কাছে বসিয়ে দেয়া হল। বাম হাতে দেয়া হল অক্ষর আঁকা তালপাতা। রোদে শুকিয়ে সবুজ পাতা হলুদাভ, কাগজের মত নরম। ডান হাতটা পন্ডিত তার নিজের হাতে তুল নিলেন। কাটখো্ট্টা বুড়োর হাতটা মেয়েদের মত নরম। আমার হাতে কঞ্চির কলম গুঁজে দিয়ে মুঠি বন্ধ করলেন। সেই মুঠিবদ্ধ হাত নিজের হাতে নিয়ে, দোয়াতের কালিতে কলম ডুবিয়ে, তালপাতার উপর ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে লিখলেন, অ, আ, ক, খ, স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ। তার মোলায়েম হাতের ছোঁয়ায় আমার শরীরে কেমন এক শিহরন বয়ে গেল। লেখা শেষে আমি নিজ আসনে বসি। পন্ডিত মশাই নিজ ধুতি দিয়ে অবলীলায় তালপাতার কালি মুছে আমায় দিয়ে বললেন;
- এহোন তুমি ল্যাহো নানুবাই।
তাকিয়ে দেখি, ময়লা ধুতিতে কালির কালো কালো ছোপ। এ দাগ কখনো উঠবে কিনা কে জানে। আমিও কঞ্চির কলম কালিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে লিখি, অ, আ, ক, খ..

সব কটা অক্ষর লিখে পন্ডিত মশাইকে দিই। লেখা দেখে খুশি খুশি গলায় বললেন,
- খুব বালো অইছে নানুবাই। খুবই বালো। জয় মা সরস্বতী।
আমার কি যেন হয়ে যায়। হঠাৎ কেন জানি টেকো মাথার এই বুড়ো পন্ডিতকে আমার এবার ঋষি মুনির মতই মনে হয়। কেউ বলেনি। তবু উঠে গিয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে আবার সালাম করি। বৃদ্ধ আমার মাথায় বুলিয়ে বলেন;
- থাউক, আর পেন্নাম হরা লাগবে না। দোয়া হরি। মা সরস্বতী তোমার উফরে সদয় অউক। বরো অইয়া তুমি জজ বেরিষ্টার অও।
অবাক হয়ে লক্ষি করি, ছলছল করছে বৃদ্ধ পন্ডিতের চোখ। কাঁদছেন কেন পন্ডিত মশাই? সেদিন বুঝিনি, আজ বুঝতে পারি, শিষ্যের ভক্তিতে জলে ভরেছিল শিক্ষা গুরুর চোখ।

আজ আমার হাতে একটি শিশুর শিক্ষা জীবন শুরু হবে। ভাবতেই কি এক ভাল লাগায় ভরে যায় মন। মেয়েটির জন্য কিছু একটা নেয়া দরকার। আমাদের সময় অক্ষর জ্ঞান শুরু হতো আদর্শ লিপি পড়ে। সীতানাথ বসাকের ১২ পৃষ্ঠার বইটি ছিল জ্ঞ্যানের ভান্ডার। নামের মতই বইয়ের পাতায় পাতায় ছিল আদর্শ বাণী। আমরা সুর করে মাথা দুলিয়ে পড়তাম, অ- অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর। আ- আলস্য দোষের আ কর। ই- ইক্ষু রস অতি মিষ্টি। ঈ- ঈশ্বরকে বন্দনা কর। কিংবা, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সেই বিখ্যাত কবিতা,
পাখী সব করে রব, রাত্রি পোহাইল। কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল।

হাতে খড়িতে এর চেয়ে ভাল উপহার আর কি হতে পারে? বইটি কিনতে যেয়ে বড়সড় হোচট খাই। বইটি নাকি পাওয়া যায় না। লাইব্রেরিয়ান বলেন;
- এ বই এখন আর কেউ কেনে না। সবাই রঙ বেরঙের লেমিনেটেড করা বই কেনে।
সে আমাকে তেমনই কিছু বই দেয়। উল্টে পাল্টে দেখি। লেখা; অ- অজগরটি আসছে তেড়ে। আ- আমটি আমি খাব পেড়ে। কিংবা, “আগডুম বাগডুম, ঘোড়াডুম সাজে, ঢাক ঢোল ঝাঝর বাজে…” আহ, লেখার কি ছিরি! এসব পড়ে শিশুরা কি শিখবে কে জানে? বলি;
- নাহ, আমার আদর্শ লিপিই চাই।
- দ্যাখেন খুঁজে, যদি পান।

অনেক খুজেপেতে ছোট এক দোকানে বইটি পাই। ধুলিতে ধুসর। সেটাই গিফ্ট প্যাক করে রওনা দিই। ঠিকানা মত পৌছুতে বেশ দেরী হয়ে যায়। আলোক সজ্জায় ঝলমল করছে চারিদিক। ভুল করে কোনো বিয়ে বাড়িতে আসিনি তো? ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকি।। বেলুনে ফেষ্টুনে, রঙিন কাগজে সেজেছে বাড়ি। রূপসী রমনীরা ব্যাস্ত আলাপনে, পড়নে না না রঙের শাড়ী। এক শিশুর হাতে খড়ি, অথচ শিশুদের উপস্থিতিই কম। আমাকে দেখেই কলি ছুটে আসে।
- দাদা, এতক্ষনে এলেন? আমি ভয়ে অস্থির, বুঝি আসবেনই না।
- তুই ডেকেছিস, না এসে পারি? কই, তোর মেয়েটা কই?
- ওই তো বসে আছে। মা ঈশিতা, এদিকে আসো, দ্যাখো কে এসেছে?

সোফার কোনে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল পরীর মত ছোট্ট এক মেয়ে। মার ডাক শুনে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে। বছর তিনেক বয়স বড়জোর। এতো ছোট বয়সেই হাতে খড়ি? এখন তো ওর পুতুল খেলার সময়। আমাকে দেখিয়ে ওর মা বলে;
- দ্যাখো, এ তোমার এক মামা। মস্তবড় ডাক্তার। বিলেতে থাকে। এনার হাতেই তোমার হাতে খড়ি হবে। তাহলে তুমিও একদিন মামার মত মস্ত ডাক্তার হবে।

অপরিচিত বলে নাকি ডাক্তারের ইঞ্জেকশনের ভয়ে, মায়ের আঁচলে মুখ লুকোয় ছোট্ট পরী। আর আঁচলের ফাক দিয়ে বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখে। আমি হাত বাড়িয়ে আদর করতে গেলেই ভয়ে কুঁকড়ে যায় মেয়েটি। বড় মায়া লাগে আমার। আহা, মুখে ওর এখনো মায়ের দুধের সোদা গন্ধ লেগে আছে। জিজ্ঞেস করি;
- এত ছোট বয়সেই হাতে খড়ি দিবি?
- দাদা যে কি বলেন? এখনি পড়াশুনা শুরু না করলে পিছে পড়ে যাবে না? ওকে ওর মামার মত বিদ্যান হতে হবে না?
হেসে বলি;
- হ্যা, তাতো নিশ্চই। নে, এই বই দিয়েই আমার হাতে খড়ি হয়েছিল। আমি চাই তোর মেয়ের অক্ষর জ্ঞ্যান এই বই দিয়েই শুরু হোক। আমার পড়া শ্রেষ্ট বই।
খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে কলি;
- কি বই দাদা?
- আদর্শ লিপি।
- ও, বাংলা! আমি তো ওকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করেছি!
হতাশ হয়ে বলে কলি। আমি কপালে চোখ তুলে বলি;
- বলিস কি? হাতে খড়ির আগেই স্কুলে ভর্তি?
কলি গদগদ গলায় বলে;
- কিন্টার গার্টেনে। আগামী সপ্তাহ থেকে যাবে।
আমার যেন বিষ্ময়ের সীমা থাকে না। মনে মনে ভাবি, কি হচ্ছে এ সব? যে মেয়ে এখনো মায়ের ভাষাই শেখেনি ভাল করে, তাকে ভর্তি করেছে ইংলিশ মিডিয়ামে? ভিনদেশী ভাষার প্রতি এ কেমন দাসত্ব আমাদের? এ কোন হীনমন্যতায় ভুগছে জাতি? মুখে বলি;
- ঘরে কে পড়াবে? তুই না ওর বাবা?
- ওর বাবার তো ঘরে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় দাদা। আর আপনি তো জানেন, ইংরেজীতে আমি কত কাঁচা! রাতে বাসায় টিউটর এসে পড়াবে।
ব্যাশ, এইটুকুই বুঝি শোনা বাকি ছিল! শিশুটির কপাল থেকে বাবা মার আদরটুকুও মুছে গেল! যে উৎসাহ নিয়ে হাতে খড়ি দিতে এসেছিলাম, তার ছিটে ফোটাও আর খুজে পাই না। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে টাক মাথার মোটা মত এক ভদ্রলোক আসেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না। কলির বর। শুনেছি সে ট্যাক্সের এক মস্ত অফিসার। শরীরের চর্বির আধিক্যে বোঝা যায়, ব্যাংকেও পয়সার আধিক্য তাঁর। বলে;
- আপনি এসে গেছেন ভাইয়া, ওর মুখে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আপনি এসেছেন শুনে বায়না ধরলো, আপনার হাতেই মেয়ের হাতে খড়ি হবে। আমিতো পাবলিক কলেজের প্রিনসিপ্যালকে বলে রেখেছিলাম।
আমি অস্ফুটে বলি, সেই ভাল হত! কলি ঝংকার দিয়ে ওঠে;
- দাদার মর্ম তুমি কি বুঝবা? দাদা আসেন, শুভ কাজটা সেরে ফেলি।
- হ্যা চল।

বিশাল এক টেবিলের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। টেবিলের উপর মস্ত বড় এক কেক। ইদানিং সব অনুষ্ঠানেই বাঙ্গালীর কেক কাটার রেওয়াজ। জন্মদিন, বিয়ে বার্ষিকী, নতুন ব্যাবসা কিংবা কোন উদঘাটন। এখন দেখি, হাতে খড়িতেও! কিন্তু হাতে খড়ির কোন সরঞ্জাম দেখতে পাই না। জিজ্ঞেস করি;
- হাতে খড়ি কি দিয়ে হবে? শ্লেট চক কই?
- দাদা যে কি বলেন? বিলেতে থেকেও বাঙ্গালীই রয়ে গেলেন! এখন ওসবে কেউ লেখে নাকি? ওর হাতে খড়ি হবে আইপ্যাডে।
- আইপ্যাডে?
- হ্যা, “হাতে খড়ি” নামে খুব ভাল একটা আ্যাপ আছে। খেলার ছলেই ও সব শিখে যাবে। ও আইপ্যাড চালাতে জানে। মামনি, আইপ্যাড অন করো।
এতক্ষনে শিশুটির মুখে হাসি ফোটে। দক্ষ হাতে আই্প্যাড অন করে। কলি আমাকে ঈশিতার একটা আঙ্গুল ধরে আ্যপে ছোঁয়াতে বলে। আমি তাই করি। আঙ্গুলের ছোঁয়ায় খুলে যায় হাতে খড়ির পেজ। সবাই হাত তালি দিয়ে ওঠে। হয়ে গেল হাতে খড়ি। তারপর মহাসমারহে কেক কাটা হল। শুরু হলো খানাপিনা। কোনো অক্ষর লেখা নয়, কোনো শিক্ষা গুরুর আশীর্বাদ নয়, নিতান্তই খেলার ছলে হয়ে গেল জীবনের পবিত্রতম ইবাদতের সূচনা। একটি শিশু, এ বয়সে যার দাদী, নানী কিংবা ময়ের কোলে বসে শোনার কথা ডালিম কুমারের গল্প, তার সময় কাটবে এখন বেতনভূক মিস এর কাছে এ বি সি ডি, কিংবা ভিনদেশী ভাষায় টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটিল ষ্টার মুখস্ত করে। উচ্চাভিলষী মা বাবার অযৌক্তিক ইচ্ছের কাছে প্রতিদিন মৃত্যু হবে একটি শিশুর সোনালী স্বপ্ন। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। তেওলা স্কুলের নাড়ু পন্ডিতের কাছে হাতে খড়ি নেয়া আমাকে এই পরিবেশে বড় বেমানান লাগে। কাউকে কিছু না বলে চুপি চুপি চলে আসি।বাইরে কুয়াশা ঢাকা শীতের রাত। আমি এলোমেলো পায়ে নিরুদ্দেশ হাটি। প্রচন্ড ঠান্ডায় নাকি অপরাধ বোধে, কেমন কেঁপে কেঁপে উঠি। মহাভারতে কৌরব সভায় দুঃশাসনের হাতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরন হয়েছিল, আজ এই অনুষ্ঠানে আমার হাতেও বুঝি একটি শিশুর শৈশব হরন হল!


সংগৃহীত, আফতাব হোসেন।
Loading...

কোন মন্তব্য নেই

lishenjun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.