লাখো জীবন বাঁচিয়েও নোবেল পুরষ্কারের দোরগোড়া থেকে ফিরেছিলেন উপেন্দ্রনাথ! কেন? #PostEdit
অরুনাভ সেনঃ সারা ভারতে বাঙালি গর্ব করে বলতেই পারে সবথেকে বেশি বার নোবেল জিতে দেশকে সন্মানিত করেছেন যারা তাদের সবার মাতৃভাষা বাংলা৷রবীন্দ্রনাথ যে গৌরবের অধ্যায় শুরু করেছিলেন,তাকে বহন কর চলেছেন অমর্ত্য সেন থেকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়৷তবুও অনেক বাঙালির নাম বলাই যায় যারা কেন নোবেল পাননি সেটাও আশ্চর্যের৷অনেকে বলেন চামড়ার মানুষ নন বলেই কি ৫০লক্ষ মানুষের অকাল মৃত্যু রুখে দিয়ে মনোনয়ন পেয়েও নোবেল পাননি কালাজ্বরের আবিস্কারক উপেন্দ্রনাথ ব্রম্বচারী?
জানি খুব যন্ত্রনাদায় একটা অভিজ্ঞতা হবে সবার,তবুও চলুন একটু কষ্ট করে ফ্লাশব্যাকে, পুত্রের পায়ের উপর মুখ গুঁজেছেন বিধবা মা৷ স্ত্রী সুপ্রভা দেবী মাথার কাছে একটা ছোট টুলে বসে, মুখে কথা নেই, বন্ধ চোখ থেকে বইছে জলের ধারা। মৃত্যু এল সুকুমার রায়ের,পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, ‘আবোল তাবোল’ ছেপে বেরনোর ন’দিন আগে। রোগের নাম কালাজ্বর।সময়টা তখন তেমনই ছিল এবং সদ্য আবিস্কৃত ইউরিয়া স্টিবামাইন তখনও সবার উপর প্রয়োগ শুরুই হয়নি৷যখন যথাযথ প্রতিষেধক না থাকার কারণে কালাজ্বরের প্রকোপে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। গোটা বিশ্বেই কালাজ্বর তখন আতঙ্ক। গবেষণা পরীক্ষা সব চলল কিন্তু সাহেব গবেষকদের কাছেও তখনও অধরা কালাজ্বরের অব্যর্থ দাওয়াই৷ব্রিটেন নিয়ন্ত্রিত অবিভক্ত ভারতেও কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে,মানুষের অকালে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে,লাফিয়ে৷অসহায় সবাই,অকাল মৃত্যুকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি বা করার আছে রোগীর,তেমনই তাঁর স্বজনদের৷মানুষের এই অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি অনেকেই, পারেন নি এক বাঙালি ডাক্তার-গবেষক৷তিনি উপেন্দ্রনাথ ব্রম্বচারী৷
এখন হয়ত কল্পনাও করা দূরহ,কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন যথাযথ প্রতিষেধক না থাকার কারণে কালাজ্বরের প্রকোপে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। দেবদূত হিসেবে এগিয়ে আসলেন একজন বাঙালি চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী তিনি সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিস্কার করতে বদ্ধ পরিকর৷চলতে লাগল পরীক্ষা-নিরীক্ষা৷এমনই জুলাই মাসের এক রাত সাল ১৯২১,পরের গল্প আরও রোমহর্ষক৷হ্যাঁ ক্যামবেল হাসপাতাল অর্থাৎ আজকের নীলরতন সরকার হাসপাতালের নাম জড়িয়ে আছে কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিস্কারে৷শুনুন বিজ্ঞানের প্রকৃত গবেষকের মুখেই সেই কথা“ক্যাম্পবেল হাসপাতালের সেই রাতের কথা মনে হলে এখনো আনন্দ পাই। রাত দশটায় লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয় ধূমাচ্ছন্ন ঘরের মধ্যে আমার গবেষণার প্রথম ফল প্রত্যক্ষ করলাম। তখনও জানতাম না ঈশ্বর আমার হাতে কী এক অমোঘ অস্ত্র তুলে দিয়েছেন ! যা দিয়ে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ রক্ষা করা যাবে। যে ঘরটিতে আমি দিনের পর দিন মাসের পর মাস কাজ করেছি সে ঘরে না ছিল গ্যাস, না ছিল জলের ট্যাপ। তবুও সে ঘর আমার কাছে চিরদিন তীর্থস্থান হয়ে থাকবে।”প্রাথমিক অবস্থায় উপেন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি অ্যান্টিমনি যৌগ তৈরি করেন ,এবং প্রতিটির প্রতিষেধক ক্ষমতা,administration route,dosing pratocol,toxicity ইত্যাদি পরীক্ষা করেন। ১৯২১ সালে জুলাই মাসে উপেন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেন তাঁর প্রস্তুত যৌগগুলির মধ্যে Urea Stibamin (carbostimamide)-Urea salt of p-stibanilic acid (p amino benzenestibonic acid,IUPAC name 4-aminophenyl stibonic acid )কালাজ্বরের প্রতিষেধক হিসাবে আশ্চর্য ফলদায়ী। গবেষণার ফলাফল দেখতে তিনি প্রথমে যৌগটি খরগোশের শরীরে প্রয়োগ করেন ও অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন তাঁর গবেষণালব্ধ ইউরিয়া স্টিবামাইন যৌগটি কালাজ্বরের বিরুদ্ধে অদ্ভুত কার্যকরী । উপেন্দ্রনাথ তাঁর গবেষণার কথা ইন্ডিয়ান রিসার্চ ফাউন্ডেশন এসোসিয়েশনকে জানান এবং মন্তব্য করেন,ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য সিঙ্কোনা চাষের যতটা প্রয়োজন,ইউরিয়া স্টিবামাইন তৈরী করার প্রয়োজনীয়তাও ঠিক ততটাই৷
এই আবিষ্কারে হইচই পড়ে গেল দেশে-বিদেশেও।কারন তার আগে ৫০এরও বেশি বছর ধরে বেশি সময় জুড়ে কালাজ্বর তার মারনলীলা চালিয়েছে অবলীলাক্রমে৷কিন্তু উপেন্দ্রনাথ ব্রম্বচারীর ইউরিয়া স্টিবামাইন হয়ে উঠল সেই রোগ থেকে মুক্তির অব্যর্থ দাওয়াই। দ্রুতই দেশের বড় বড় হাসপাতালে, চা বাগানে এই ওষুধ ব্যবহার হওয়া শুরু হল৷ একই সঙ্গে আরও এক ম্যাজিকের স্বাক্ষী হতে থাকলেন তৎকালীন প্রশাসক থেকে ডাক্তারেরা৷এক লহমায় ভয়ঙ্কর কালাজ্বরের মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশ থেকে নামিয়ে আনা গেল ১০ শতাংশে। ১৯৩২ সালে কালাজ্বরের প্রকোপ থেকে সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখাটা দাঁড়াল ৫০ লক্ষেরও বেশি৷ভাবুন ১৯২১ থেকে ১৯৩২সালের মধ্যে কালাজ্বরে আক্রান্ত মানুষরা যদি উপেন্দ্রনাথ ব্রম্বচারীর আবিস্কৃত ইউরিয়া স্টিবামাইন না পেতেন নিশ্চিত ভাবে তাঁদের ধীরে-ধীরে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়া ছাড়া আর বোধহয় কিছুই করনীয় ছিল না৷এর আরও কিছুদিন পরে কালাজ্বরে মৃত্যুর হার নেমে আসে ৭ শতাংশে। ভারতের সঙ্গে বিশ্বের বহু দেশে ভারতীয় এই ধন্বন্তরী চিকিৎসক-গবেষকের আবিস্কৃত ওষুধের ব্যবহার শুরু হয়৷ মহান এই মানুষটি কিন্তু ইচ্ছাপ্রকাশ করলেই ইউরিয়া স্টিবামাইনের পেটেন্ট নিতে পারতেন৷
বিপুল টাকার মালিক হওয়াটা ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা৷কিন্তু তিনি হাঁটলেন স্রোতের বিপরীত রাস্তায়৷পেটেন্ট তো নিলেনই না ভারতের প্রায় সমস্ত হাসপাতালকে বিনামূল্যে ইউরিয়া স্টিবামাইন বিলিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ।ব্যক্তি জীবনে উপেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রবল দয়ালু।তাঁর কাছ থেকে বিনামুল্য ইউরিয়া স্টিবামাইন পায়নি,ভারতে এমন কোন হাসপাতাল ছিল না বললেই হয়।দরিদ্র রোগীদের কথা ভেবে তিনি সরকারের কাছে ইউরিয়া স্টিবামাইন কেনা দামে বিক্রি করতেন ও এই ওষুধের কোন পেটেন্ট নেন নি। আজও বোধহয় বাঙালি তথা ভারতের মানুষ বুঝতে পারেন না সারা বিশ্বের ৫০লক্ষেরও বেশি মানুষের অকাল মৃত্যু যিনি রুখতে পেরেছিলেন তিনি হয়ত সাদা চামড়ার মানুষ নন বলে মনোনয়ন পেয়েও নোবেল পাননি৷উপেন্দ্রনাথের সময় স্পেসিফিক ড্রাগ বা বিশেষ ওষুধ বলতে যা বোঝায় তা ছিল খুবই কম,যেমন ম্যালেরিয়ার জন্য কুইনিন,অ্যানিমিয়ার জন্য আয়রন,সিফিলিসের জন্য আর্সেনিক যৌগ ইত্যাদি।অন্য সব অসুখের চিকিৎসা হত palliative উপায়ে, রোগের মূল কারণ না খুঁজে সাময়িকভাবে যন্ত্রণা উপশমের ওষুধ দিয়ে।,অ্যান্টিবায়োটিক তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।এইসব বিচার করলে বোঝা যায় রসায়নবিদ্যাকে চিকিৎসার কাজে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
রোনাল্ড রস নোবেল পেলেন ম্যালেরিয়ার কারন আবিস্কারের জন্য,অথচ একই রকম ভয়ঙ্কর রোগ কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করেও উপেন্দ্রনাথকে নোবেল পাওয়ার যোগ্য মনে হয়নি নোবেল কমিটির বিশেষজ্ঞদের কাছে৷অনেকে বলেন যদি উপেন্দ্রনাথের গায়ের চামড়া সাদা হত তাহলে এই মহান চিকিৎসক কবেই নোবেল পেতেন৷তার দূর্ভাগ্য তিনি পরাধীন ভারতের সন্তান ছিলেন,তাঁর গায়ের চামড়া সাদা ছিল না৷ সেইজন্য মনোননয় পেয়েও নোবেল না পেলেও উপেন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার ক্ষমতা ব্রিটিশদেরও হয় নি৷।
নোবেল না পেলেও তিনি নাইট উপাধি পেয়েছিলেন৷সত্যি কথা বলতে কি উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী পরাধীন ভারতের বুকে জন্ম নেওয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী৷ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী বিশ্বের কাছে মূলত একজন আবিষ্কারক এবং লিশমেনিয়া গোত্রের পরজীবী ঘটিত রোগের প্রতিষেধক হিসেবে সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ থেরাপিউটিক এজেন্ট ইউরিয়া স্টিবামাইনের জনক হিসেবে পরিচিত হলেও, যারা ভারতীয় উপমহাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্র সম্বন্ধীয় গবেষণা সম্পর্কে একটু হলেও আগ্রহী, তারা জানেন তিনি ছিলেন সহজাত মৌলিক গবেষক এবং বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য ও অপরিসীম কৌতূহল সম্পন্ন একজন অক্লান্ত পর্যবেক্ষক।
জানি খুব যন্ত্রনাদায় একটা অভিজ্ঞতা হবে সবার,তবুও চলুন একটু কষ্ট করে ফ্লাশব্যাকে, পুত্রের পায়ের উপর মুখ গুঁজেছেন বিধবা মা৷ স্ত্রী সুপ্রভা দেবী মাথার কাছে একটা ছোট টুলে বসে, মুখে কথা নেই, বন্ধ চোখ থেকে বইছে জলের ধারা। মৃত্যু এল সুকুমার রায়ের,পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, ‘আবোল তাবোল’ ছেপে বেরনোর ন’দিন আগে। রোগের নাম কালাজ্বর।সময়টা তখন তেমনই ছিল এবং সদ্য আবিস্কৃত ইউরিয়া স্টিবামাইন তখনও সবার উপর প্রয়োগ শুরুই হয়নি৷যখন যথাযথ প্রতিষেধক না থাকার কারণে কালাজ্বরের প্রকোপে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। গোটা বিশ্বেই কালাজ্বর তখন আতঙ্ক। গবেষণা পরীক্ষা সব চলল কিন্তু সাহেব গবেষকদের কাছেও তখনও অধরা কালাজ্বরের অব্যর্থ দাওয়াই৷ব্রিটেন নিয়ন্ত্রিত অবিভক্ত ভারতেও কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে,মানুষের অকালে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে,লাফিয়ে৷অসহায় সবাই,অকাল মৃত্যুকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি বা করার আছে রোগীর,তেমনই তাঁর স্বজনদের৷মানুষের এই অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি অনেকেই, পারেন নি এক বাঙালি ডাক্তার-গবেষক৷তিনি উপেন্দ্রনাথ ব্রম্বচারী৷
এই আবিষ্কারে হইচই পড়ে গেল দেশে-বিদেশেও।কারন তার আগে ৫০এরও বেশি বছর ধরে বেশি সময় জুড়ে কালাজ্বর তার মারনলীলা চালিয়েছে অবলীলাক্রমে৷কিন্তু উপেন্দ্রনাথ ব্রম্বচারীর ইউরিয়া স্টিবামাইন হয়ে উঠল সেই রোগ থেকে মুক্তির অব্যর্থ দাওয়াই। দ্রুতই দেশের বড় বড় হাসপাতালে, চা বাগানে এই ওষুধ ব্যবহার হওয়া শুরু হল৷ একই সঙ্গে আরও এক ম্যাজিকের স্বাক্ষী হতে থাকলেন তৎকালীন প্রশাসক থেকে ডাক্তারেরা৷এক লহমায় ভয়ঙ্কর কালাজ্বরের মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশ থেকে নামিয়ে আনা গেল ১০ শতাংশে। ১৯৩২ সালে কালাজ্বরের প্রকোপ থেকে সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখাটা দাঁড়াল ৫০ লক্ষেরও বেশি৷ভাবুন ১৯২১ থেকে ১৯৩২সালের মধ্যে কালাজ্বরে আক্রান্ত মানুষরা যদি উপেন্দ্রনাথ ব্রম্বচারীর আবিস্কৃত ইউরিয়া স্টিবামাইন না পেতেন নিশ্চিত ভাবে তাঁদের ধীরে-ধীরে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়া ছাড়া আর বোধহয় কিছুই করনীয় ছিল না৷এর আরও কিছুদিন পরে কালাজ্বরে মৃত্যুর হার নেমে আসে ৭ শতাংশে। ভারতের সঙ্গে বিশ্বের বহু দেশে ভারতীয় এই ধন্বন্তরী চিকিৎসক-গবেষকের আবিস্কৃত ওষুধের ব্যবহার শুরু হয়৷ মহান এই মানুষটি কিন্তু ইচ্ছাপ্রকাশ করলেই ইউরিয়া স্টিবামাইনের পেটেন্ট নিতে পারতেন৷

No comments