বাঙালির "ডাল" এর সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক নিবিড়!! জানতে হলে পড়ুন বিশেষ প্রতিবেদন "ইতিহাসে ডাল"
নজরবন্দিঃ গোমাংস নয়। আওরঙ্গজেবের ভাই মুরাদের প্রিয় ছিল মোরাদাবাদি ডাল। আজও রান্নাঘরে তার রমরমা। রাজপুত্রের নিদান মেনে পরিবেশিত হয় খাওয়ার শুরুতেই। শাহজাহানের সিংহাসন কেড়ে নিয়েছিলেন প্রিয়তমা মুমতাজ মহলের ষষ্ঠ গর্ভ। আওরঙ্গজেব। কিন্তু মগজের তরোয়ালের বদলে যদি যোগ্যতার মানদণ্ডে হিন্দুস্তানের উত্তরাধিকার নির্ণীত হত, তা হলে আমজনতার নয়নমণি, শাহজাহানের কলজের টুকরো দারা শিকোহ বসতেন মসনদে। আর যোগ্যতার লিস্টিতে জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা-র ঠিক পরেই আসার কথা কনিষ্ঠ মুরাদ বক্সের। জীবনে একটা ভুল করে ফেলেছিলেন এই শাহজাদা, এক ভুলেই হারিয়ে গেলেন।
কখনও ডালের ওপর আজমেরি মশলা ছড়ায়, কখনও ছিটিয়ে দেয় হালকা ঝাঁজের ধনেগুঁড়ো। কোনও দিন রাজকুমার চান থকথকে ডাল খেতে। জোধাবাইয়ের মন্ত্র মেনে ঘন ডালে ঘি ভাসিয়ে পরিবেশন করা হয় তাঁকে। কটকটে ঝাল লঙ্কার কুচি দেওয়া ডালও খুব পছন্দ তাঁর। দেখা গেল, যুদ্ধক্ষেত্রের চেনা খাবার, পেঁয়াজ দিয়ে সাঁতলানো ডালও রসিয়ে খাচ্ছেন তিনি। শুনে শাহজাহান নিশ্চিত, মুরাদ পাক্কা যোদ্ধা হবেন। বেশ ক’বছর পর। জাঁহাপনা শয্যাশায়ী, মুরাদ রুস্তমনগর শাসন করছেন। তাঁর সম্মানে সে জেলার নতুন নাম হয়েছে মোরাদাবাদ। সেখান থেকে মুরাদ এত্তেলা পাঠালেন রাজধানীতে। রাজপুত হেঁশেলের সেরা রাঁধুনিকে মোরাদাবাদ পাঠাতে হবে। বাবরের বংশে তখন ঘোর দুঃসময়ের শুরু। সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করছেন আওরঙ্গজেব। পিতার দিকে পুত্র, ভাইয়ের দিকে বোন, ভাইয়ের দিকে ভাই আড়ে-ঠারে চাইছে। এমন বিষাক্ত সময়ে মুরাদের আবদার রাখতে খাস পাচককে তাঁর দরবারে পাঠিয়ে দেওয়া হল— এমন তথ্য নিয়ে ইতিহাসে বিস্তর ধন্দ। তবে, কোনও এক ওস্তাদকে তিনি পেয়েছিলেন তা সত্যি। জোধাবাইয়ের পাঁচমেল ডাল ফের ফিরেছিল তাঁর রেকাবিতে। তবে, ক’দিন পরই তাতে ঘোর অরুচি মুরাদের। নতুন হুকুম গেল পাকশালে। ডালই চাই, কিন্তু সোয়াদ হবে একটু ভিন্ন। সোরবা কিসিমের পাতলা। কিন্তু, তাতে বড়িআম্মির হেঁশেলের ঘ্রাণ থাকতেই হবে। হাতযশ দেখাল এক পাচক। জোধা-র অড়হর ডালের বদলে কড়ায় ঢালল শাহি মুগ ডাল। মশলা মোটামুটি এক। ঢিমে আঁচে পাঁচ ঘণ্টা, কিংবদন্তি বলে টানা ১০ ঘণ্টা নাগাড়ে কড়ায় সেই হাতা ওলটাল-পালটাল। মুরাদ খেলেন বটে, কিন্তু ভালমন্দ কিছু বললেন না।
পর দিন পাচক আবার পাতে দিল একই ডাল। শুধু শাহজাদার কাছে নিয়ে যাবার আগে ওপরে অল্প আমচুর মিশিয়ে, লাল লঙ্কা সাজিয়ে দিল। মুরাদ ডালের বাটি একেবারে সাফা করে দিলেন। সাহস পেয়ে, পাচক পর দিন ডালে দিল একটু পেঁয়াজকুচি। খেতে খেতে চোখ বুজে এল শাহজাদার। সেই থেকে শাহজাদা রোজ দিনে তিন বার এই ডালের ফরমায়েশ করতেন। এক বার নোনতা, তার পর মিষ্টি, কখনও বা হালকা ঝাল। কিন্তু, হায়! সুখের দিন ফুরিয়ে এল। সম্রাট বৃদ্ধতর হলেন, তখ্ত দখল করতে চার ভাইয়ের মধ্যে প্রলয়। নিয়তির বেআক্কেলে সে যুদ্ধে, আওরঙ্গজেবের সঙ্গী হলেন মুরাদ। এই দাদাটি তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, দুই ভাইয়ে মিলে ভাগ করে ভোগ করবেন সাম্রাজ্য। কিন্তু, ক’দিন পরেই তাঁবুতে ডেকে মুরাদকে নেশায় মাতালেন আওরঙ্গজেব। হুঁশ যখন ফিরল, মুরাদ তখন গ্বালিয়র ফোর্টের কারাগারে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে ছোট ভাইয়ের সব আরামে ছাই ঢেলেছিলেন নতুন মুঘল সম্রাট। অন্তিম দিন ক’টায় ছাড় পেয়েছিল কেবল মুরাদের সেই ডাল চাখার আয়েশটুকু। সেই বিখ্যাত ডাল প্রায় চারশো বছর পেরিয়ে আজও বেঁচে। তাকে আমরা চিনি প্রাপ্তিস্থানের নামমাহাত্ম্যে, ‘মোরাদাবাদি ডাল’ নামে। শাহজাদা-র মর্জি মেনেই নানা বর্ণে নানা আয়োজনে দেখা মেলে তার। রাস্তাঘাটে তার ফকিরসাজ। ছাউনি-গুমটিতে পেঁয়াজ-ছড়ানো ডাল-চাট সেজে সে শ্রান্ত পথিকের খিদে মেটায়। গৃহস্থের কাছে সে আসে সরল-সিধে রূপে, শরীর জুড়ে ঘি-সুবাস, ধনেপাতার সুগন্ধ। পাঁচতারা, উৎসব, বিয়েশাদিতে তার রাজবেশ। মশলায় জারিয়ে, জমকদার স্বাদে হাজির হয় বহুমূল্য পাত্রে। যেখানে যে ভাবেই থাকুক, একটি কথা সার। আজও মুরাদ বক্সের নিদান মেনে মূল পাঁচ পদের সঙ্গে নয়, মোরাদাবাদি ডাল পরিবেশিত হয় খাবার আগে। ক্ষুধাবর্ধক বা নাস্তা রূপে। আর এই ডাল খেয়ে কোনও সমঝদার যদি তারিফ করেন, সেই নজরানা কি কবুল করেন সমাধিতে শুয়ে থাকা এক হতভাগ্য শাহজাদা?
সংগৃহিত।
Loading...
কোন মন্তব্য নেই