Header Ads

শিল্পের জন্যেই শিল্পী শুধু... জন্মদিনে তাই স্মরনে শপথে রামকিঙ্কর বেজ। মৃন্ময় দে-র কলমে।

মৃন্ময় দেঃ 'রামকিঙ্কর বেজ' (২৬.০৫.১৯০৬ - ০২.০৮.১৯৮০), বলতে কোনো দ্বিধা নেই এই নামটা অনেক মানুষের মতোই আমার কাছেও প্রথমজীবনে পাঠ্য বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন নিয়ে পড়তে গিয়ে শুধুই আনুষঙ্গিক নাম হিসাবেই ছিল ও সেটাই থেকে যেতো যদিনা এই প্রাপ্ত বয়সে শান্তিনিকেতন আশ্রম ঘুরতে যেতাম। বড়জোর কোনো এক পরিণত আড্ডায় হঠাৎ ছিটকে আসা টপিক হিসাবে আমাদের গড়পড়তা বাঙালি মানসিকতায় ওঁনাকে বিচার করতাম ওঁনার অবিন্যস্ত জীবনযাপন দিয়ে। এবং সেই বিচারের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ওঁনার অপূর্ব সুন্দর এবং সেই সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা প্রচলিত ফর্মেশন ভাঙা শিল্পকীর্তি চাপা পড়ে থাকতো চিরকালের মতো। অবশ্য আমিও তো বিশুদ্ধ বাঙালি আর তাই টিপিকাল বাঙালি মানসিকতা থেকে আলাদা কি করেই বা হবো। সেই কবে 'মাইকেল মধুসূদন - গিরিশ ঘোষ থেকে হাল আমলের ঝৃত্বিক - শক্তি - সুনীল', আমরা তো চিরকাল বিচার করে এসেছি এদেরকে প্রধানত বোহেমিয়ান জীবনযাপনের নিরিখে। ভাগ্যিস রামকিঙ্কর বেজ মহাশয়ের ক্ষেত্রে আমার সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হলো না । কি অপূর্ব ও জীবন্ত ওঁনার সৃষ্ট শিল্পগুলো। ঐ একই শিল্পসুষমা রাতের আলোয় দেখার লোভে সন্ধ্যার পরে আবার ফিরে গেছি ঐ আশ্রম প্রাঙ্গনে আর মুগ্ধতার সাথে দেখেছি যে, আলোর তারতম্যে ঐ একই সৃষ্টি কীরকম বিচিত্রতা যোগ করে।

সবথেকে বড় কথা ঐ বোহেমিয়ানার তলায় চাপা পড়ে গেছে 'মানুষ ও শিল্পী রামকিঙ্কর'। সেই কৈশোর থেকেই ছিলো ওঁনার মূর্তি গড়ার এতটাই অনুরাগ ছিলো যে বাঁকুড়ার শহরের পাশে গন্ধেশ্বরী নদীর ধার থেকে মাটি তুলে নিজের খেয়ালেই মূর্তি তৈরী করতেন। এমনকি বাড়ির কাছে বারাঙ্গনা পাড়ায় ভরদুপুরে মূর্তি গড়ার দায়িত্বও সেই স্কুল বয়সেই ওঁনার ছিলো। আবার ঐ বয়সেই ছিলো ওঁনার কাগজ - রং কিনে ছবি আঁকার শখ।
পরবর্তী জীবনে মাত্র ১৯ বছর বয়সে যখন উঁনি প্রথাগত শিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতন আশ্রমে এসে পৌঁছলেন, তৎকালীন শিক্ষাগুরু 'আচার্য নন্দলাল বসু' তাঁর আঁকা দেখে বলেছিলেন 'সব তো শিখেই এসেছো ...'। সেই মানুষটাই পরবর্তী সময়ে প্রথাভাঙা শিল্পের নতুন ধারা এনেছিলেন। আবার শান্তিনিকেতনে 'অয়েল পেন্টিং' এর কাজ উঁনি প্রথম শুরু করেন। ওঁনার ভাবনার স্বকীয়তা এতটাই ছিলো যে টাকার অভাবে ব্রোঞ্জ ঢালাইয়ের কাজ বন্ধ না করে কংক্রিট আর স্টোনচিপস মিশিয়ে কাজ করে যেতেন।

তিনি এতটাই 'ন্যাচারাল' ছিলেন যে প্রখর রোদ বা অভুক্ত শরীর, কোনো কিছুই ওঁনার শিল্পসৃষ্টির পথে বাধা হতে পারেনি। তিনি বলতেনও সে কথা, 'উপোসটুপোসও মনে থাকে না কাজের মধ্যে ঢুকে পড়লে'। সৃষ্টির নেশায় তখনকার বিদ্যুৎহীন শান্তিনিকেতনে সন্ধ্যার পরে লন্ঠন জ্বালিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পর্যবেক্ষণ করতেন আর কাজ করে যেতেন।
শিল্পী ও মানুষ, দুই সত্তাই ছিলো ওঁনার নিজস্ব আর তাই প্রবল সমালোচনা সত্বেও ওঁনার প্রতিটা সৃষ্টিতে 'প্রথামাফিক শিল্পের বাইরে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ওঁনার সৃষ্টির প্রধান উপাদান হয়ে থেকেছে।' আবার ব্যাক্তিগত জীবনেও মানুষটা এতই 'স্বভাবখেয়ালি' ছিলেন যে এক এক সময় বিড়ি কেনার টাকা না থাকা সত্ত্বেও বিছানার শতরন্চির নীচে থাকা চেকের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও তা ওঁনার খেয়াল থাকতো না।আশেপাশের কুকুর - বিড়ালরা ওঁনার সাথে এক পাতে খেয়ে যেত।

'রবীন্দ্রভাবনার যোগ্য ধারক ও বাহক, আধুনিক পাশ্চাত্য ও সনাতন ভারতীয় শিল্পধারার মেলবন্ধন ঘটানো তথা আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যের প্রানপুরুষ' এই প্রতিভাবান মানুষটাকে তাঁর জন্মদিনে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম ও অন্তরের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। সাথে রইলো আমার তোলা ছবিতে শান্তিনিকেতন আশ্রমে ওনার অপূর্ব শিল্পসৃষ্টির কিছু নমুনা।

Loading...

কোন মন্তব্য নেই

lishenjun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.